আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
গোটা বিশ্বের এখন আলোচনার বিষয় মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ইস্যু। দেশটির সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধদের হামলার শিকার হয়ে প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। জাতিসংঘ একে জাতিগত নিধন এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত সৃষ্ট সঙ্কট বলে অভিহিত করেছে। গত ২৫ আগস্ট সর্বশেষ সহিংসতা শুরুর পর থেকে সংস্থাটিকে (জাতিসংঘ) বেশ তৎপরও মনে হচ্ছে। কিন্তু এই সঙ্কটের শুরুতে যদি জাতিসংঘ কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারতো তাহলে আজ এটি ভয়াবহ আকার ধারণ করতো না। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে- জাতিসংঘের ব্যর্থতার কারণেই কী রোহিঙ্গা মুসলমানদের আজ এই পরিণতি? ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির করা এক প্রতিবেদনে এমনই প্রশ্ন তোলা হয়েছে। দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর তৈরি করা ওই প্রতিবেদনে জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়ে যে প্রশ্ন তোলা হয়েছে তা অস্বীকার করা হয়েছে সংস্থাটির (মিয়ানমার অফিস) পক্ষ থেকে। সংস্থাটি ও অন্যান্য মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সূত্রের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারে জাতিসংঘের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এক কর্মকর্তাই রোহিঙ্গা সংকটকে দেশটির সরকারের কাছে তুলে ধরেননি। শুধু তাই নয়, মানবাধিকার সংগঠনগুলো যাতে সঙ্কটকবলিত এলাকা পরিদর্শন না করতে পারে তারও ব্যবস্থা করেছেন রেনেটা লক ডেসালিয়েন নামের ওই কর্মকতা। এমনকি বিষয়টি প্রকাশ্যে নিয়ে আসতেও বাধা সৃষ্টি করেছেন তিনি।
এ ছাড়া যেসব কর্মকর্তা বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলার চেষ্টা করেছেন এবং সতর্ক করতে চেয়েছেন যে, এভাবে চলতে থাকলে জাতিগত নিধন অনিবার্য, তাদেরকেও তিনি বিচ্ছিন্ন করে রেখেছেন।
ক্যারোলিন ভ্যান্ডিনাবিলি নামের এক ত্রাণ কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেছেন, প্রথম যখন তিনি মিয়ানমারে পৌঁছেন তখন সেখানকার পরিস্থিতি দেখে আতঙ্কিত হন। এর আগে রুয়ান্ডার গণহত্যাও দেখেছেন তিনি।
ক্যারোলিন বলেন, ‘আমি কিছু পূর্বসূরী ও বার্মিজ (মিয়ানমারের আরেক নাম) ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলার সময় রাখাইন ও রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করি। তখন এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমাদের উচিত ওদের সবগুলোকে মেরে ফেলা, কারণ ওরা কুকুরের মতো’।’ মানবতার প্রতি এমন অমানবিকতা দেখে আমি অত্যন্ত হতাশ হয়ে যাই,’ বলেন ক্যারোলিন।
বিবিসির জোনাহ ফিশারের তৈরি করা ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১২ সালের সহিংসতার পর সেখানকার বৌদ্ধরা এতটাই ভয়ংকর হয়ে উঠে যে, কোনো ধরনের ত্রাণ বা মানবিক সাহায্য পৌঁছে দিতেও বাধা দেয়া হয়। এমনকি ত্রাণবাহী যানবাহনে হামলাও চালানো হয়। আর জাতিসংঘের পক্ষ থেকে দেশটিতে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা রোহিঙ্গা ইস্যুতে কথা বললে বৌদ্ধরা ক্ষেপে যাবেন এজন্য কোনো কথা বলতেন না। বিষয়টি এমন যে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে কথা বলার ওপর যেন অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা ছিল।
এমন অবস্থায় জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রাখাইনে দীর্ঘমেয়াদি নীতি গ্রহণ করে। তারা মনে করেন, রাখাইনে যদি উন্নয়ন করা যায় তাহলে সেখানকার রোহিঙ্গা ও বৌদ্ধদের মধ্যে উত্তেজনা কমতে পারে। কিন্তু সেটাও সম্ভব হয়নি।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, জাতিসংঘ এমন অনেক প্রেস রিলিজ দিয়েছে যেখানে রোহিঙ্গাদের মূল সমস্যার কথা উল্লেখই করা হয়নি। আর মিয়ানমার সরকার তো তাদের রোহিঙ্গা কিংবা স্বতন্ত্র গোষ্ঠী হিসেবে স্বীকারই করে না। এর পরিবর্তে সরকার তাদের ‘বাঙালি’ বলে চিহ্নিত করে।
প্রতিবেদক বলেন, মিয়ানমারে আমি দীর্ঘদিন যাবত কাজ করছি। কিন্তু জাতিসংঘের কোনো প্রতিনিধিকে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে খোলাখুলি মুখ খুলতে দেখিনি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের অনেক সমস্যার কথা ফাইলবন্দি করে রাখা হতো।
মিয়ানমারে ত্রাণ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত এমন একাধিক সূত্র বিবিসিকে বলেছেন, দেশটিতে জাতিসংঘের শীর্ষ পর্যায়ের যে বৈঠক হতো সেখানে দেশটির কর্তৃপক্ষের কাছে রোহিঙ্গাদের অধিকার দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়াও একপ্রকার অসম্ভব ছিল। এ ব্যাপারে ডেসালিয়েনের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি রাজি হননি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে জাতিসংঘ বিবিসির এইসব অভিযোগ একবারে অস্বীকার করেছে। জাতিসংঘের ইয়াঙ্গুন (সাবেক রাজধানী) ভিত্তিক অফিসের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘আমরা শক্তভাবে এইসব অভিযোগের বিরোধিতা করছি। আবাসিক সমন্বয়ক আলোচনায় কোনো বাধা দেয়নি, বরং রাখাইন রাজ্যে কিভাবে শান্তি ফেরানো যায় তা নিয়ে নিয়মিত জাতিসংঘের সকল সংস্থার সঙ্গে বৈঠকের ব্যবস্থা করেছে।’
একটি সূত্র বিবিসিকে জানিয়েছে, জাতিসংঘ রোহিঙ্গা ইস্যুতে কী ভূমিকা রেখেছে তা জানার জন্য একটি তদন্ত শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের বিতর্কিত অবসানের পর জাতিসংঘ যে তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছিল, এটিও তার চেয়ে বেশি কিছু হবে না বলে মনে করা হচ্ছে।
দৈনিক দেশজনতা/এন এইচ