বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক :
তথ্য-প্রযুক্তির অসীম দুনিয়ায় শিশুদের জন্য জানালা খুলে দিয়েছে ইন্টারনেট। আবার বাইরের কাউকে তাদের ওপর গোপন নজরদারির সুযোগও দিয়েছে। শিশুরা অনলাইনে যাদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলে, অনেক সময় তাদের প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায় না। অনলাইনে তাদের সত্যিকারের পরিচয় নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না বলেই ম্যালওয়্যার আক্রমণ কিংবা বিপজ্জনক সিস্টেম হ্যাকিংয়ের আশঙ্কা তৈরি হয়।
এছাড়া পর্নোগ্রাফিক কনটেন্ট কিংবা হানাহানির দৃশ্য শিশুদের কোমল মনে ভীতির সঞ্চার করতে পারে। অনেক সময় প্রযুক্তি জানা শিশুও যথেষ্ট দূরদৃষ্টির অভাবে বিপদে পড়ে যায়। অনেক শিশু গুজব ছড়ানো কিংবা মজা করে অন্যের অ্যাকাউন্ট হ্যাক করার মতো বিষয়ে জড়িয়ে পড়তে পারে।
তাদের কাছ থেকে ফোন বা ইন্টারনেট সংযোগ কেড়ে নেওয়াটা এর সমাধান হতে পারে না। বরং তাদের নজরদারির মধ্যে রেখে এবং নিয়ন্ত্রিত ইন্টারনেট ব্রাউজিংয়ের মাধ্যমে অনলাইনের বিপদ সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া যায়।
শিশুদের অনলাইনে নিরাপদ ও সঠিকভাবে ব্রাউজিং শেখানোর দায়িত্ব অভিভাবকদের। প্রযুক্তি শিক্ষা দেওয়ার চেয়ে প্রযুক্তি বিষয়ে নিরাপদ থাকা ও ভালো আচরণ শিক্ষা দেওয়া কর্তব্য। অনলাইন দুনিয়ায় কোনটি উচিত আর কোনটি অনুচিত সে বিষয়ে শিশুদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে নৈতিক আচরণ শিক্ষা দেওয়া যায়। শিশুদের অনলাইনে নিরাপদ রাখার কয়েকটি পরামর্শ দিয়েছেন সাইবার বিশেষজ্ঞরা।
নিরাপদ যন্ত্রের ব্যবহার :
বাড়িতে সব ইন্টারনেট সুবিধার যন্ত্রগুলো নিরাপদে রাখুন। শিশু যদি শুধু ডেস্কটপ ব্যবহার করে, সেটিকেও নিরাপদ রাখুন। শিশুরা সাধারণত তার মা-বাবার ফোন বা ল্যাপটপে গেম খেলে। আপনার মোবাইল, ল্যাপটপ, ট্যাব কিংবা ডেস্কটপে নিরাপদ সফটওয়্যার ইনস্টল করে রাখুন। হালনাগাদ নিরাপত্তা সফটওয়্যার সক্রিয় থাকলে এসব যন্ত্রে সহজে ভাইরাস ঢুকতে পারবে না।
নিরাপদ ইন্টারনেট সংযোগ :
আপনার কম্পিউটারে প্যারেন্টাল কন্ট্রোল সিস্টেম চালু করে রাখুন। প্রতিটি শিশুর জন্য আলাদা লগ ইন আইডি ও পাসওয়ার্ড সেট করে দিন। শিশুদের অ্যাডমিন পাসওয়ার্ড জানানোর প্রয়োজন নেই।
ব্রাউজার ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম নিরাপদ রাখুন :
শিশুদের উপযোগী ব্রাউজার ও তাদের গেম খেলা বা প্রকল্প তৈরির জন্য আলাদা ব্রাউজার ঠিক করে দিন। শিশুদের ই-মেইল অ্যাকাউন্ট কিংবা সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে প্রাইভেসির বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখুন। শিশুরা যাতে শুধু পরিচিতজনের সঙ্গেই যোগাযোগ করে, সে বিষয়টিতে পরামর্শ দিন। জিপিএস, ওয়েবক্যাম নিষ্ক্রিয় করে রাখুন। পপ-আপ ব্লক করে দিন।
সময় ঠিক করে দিন :
আপনার সন্তান যখন কিশোর বয়সী, তখন তারা গেম খেলা ও ভিডিও দেখতে বেশি আগ্রহী হয়। যখন-তখন যাতে ইন্টারনেটে যেতে না পারে, সে জন্য ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখুন। কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে প্যারেন্টাল কন্ট্রোল ব্যবহার করুন এবং তারা কোন ওয়েবসাইটে যাবে তা ঠিক করে দিন। কখন তারা ইন্টারনেট ব্যবহার করবে, সে সময়ও নির্ধারণ করে দিন।
দরকারি শিক্ষা :
বাস্তব জীবনে যে বিষয়গুলো শেখার প্রয়োজন, অনলাইন দুনিয়ায় সেই বিষয়গুলো শিক্ষা দিন। শিশুকে সচেতন হওয়ার শিক্ষা দিন। সংযত হয়ে কথা বলা কিংবা কার সঙ্গে কীভাবে কথা বলবে, সে বিষয়টিও শিখিয়ে দিন।
যোগাযোগ :
নিয়মিত শিশুর খোঁজখবর রাখুন। তার সঙ্গে কথা বলুন এবং তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। শিশুর অনলাইন দুনিয়ার অভিজ্ঞতা শুনুন। সাইবার জগতের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে তাকে জানান। বন্ধুদের কেউ এরকম কোনো সমস্যায় পড়েছে কি না, তা জেনে নিন।
নজরদারিতে রাখুন :
আপনার শিশুকে একা একা পার্কে কি খেলতে দেবেন? নিশ্চয়ই না? অনলাইনের ক্ষেত্রেও এ বিষয়টি মনে রাখুন। শিশুর ব্যবহৃত কম্পিউটার অবশ্যই সবার সামনে রাখবেন আর কম্পিউটারে স্ক্রিনটি দরজা বরাবর রাখবেন। অর্থাৎ শিশুদের আপনার চোখের আড়ালে কোনোরূপ যোগাযোগ করতে দেবেন না।
বিনা মূল্যে কিছু পাওয়ার লোভ সামলান :
অনলাইনে কোনো কিছু বিনা মূল্যে পাওয়ার অফার সম্পর্কে শিশুদের সতর্ক করুন। আমরা সবাই যেমন জানি, বিনা মূল্যে কিছুই পাওয়া যায় না, তাদেরও সেটা বোঝান। বিনা মূল্যে ওয়ালপেপার, গেম, পোস্টার প্রভৃতি ডাউনলোড না করার জন্য বলুন। এ ধরনের অফারের সঙ্গে ম্যালওয়্যার থাকতে পারে যা বিভিন্ন তথ্যের বিনিময়ে ইনবক্সে চলে আসে।
শোবার সময় মোবাইল নয় :
ঘুমানোর আগে কোনো যন্ত্র, এমনকি মোবাইল ফোন যেন শিশুর সঙ্গে না থাকে, সে বিষয়টি খেয়াল রাখুন। রাতের খাবারের পর কোনো চ্যাটিং, টেক্সটিং কিংবা ইমেইল দেখা না হয়, সেটিই নিয়ম করে দিন।
নৈতিক শিক্ষা :
শিশুদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্যই নৈতিক শিক্ষা দিন। চ্যাটরুমে যাওয়া, কোনো কিছু কপি পেস্ট করে নিজের নামে চালানো, অবৈধভাবে কোনো গান বা ছবি ডাউনলোড করতে না করুন। কারও সঙ্গে অনলাইনে বিবাদ না করতে, কাউকে গালি না দিতে, বয়স লুকিয়ে কোনো সামাজিক যোগাযোগের সাইটে অ্যাকাউন্ট তৈরি করতে কিংবা কোনো গুজব ছড়ানোর বিষয়ে তাদের সতর্ক করুন।
চিন্তা করতে শেখান :
অনলাইনে শিশুদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিষয় শেখাবেন। থামো, চিন্তা করো তারপর যোগাযোগ করো। কোনো বিষয়ের জবাব দিতে, টুইট করতে, কোনো কিছু লাইক করতে বা পোস্ট করার আগে সেটি ঠিক হচ্ছে কি না, তা একটু সময় নিয়ে ভেবে তারপর করা উচিত।
সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে, ইন্টারনেট হচ্ছে শিক্ষা, বিনোদন ও যোগাযোগের চমৎকার একটি উৎস। এটি ভবিষ্যতের একটি টুল। ইন্টারনেট থেকে শিশুকে শিক্ষা নিতে বাধা দেবেন না। এর পরিবর্তে তাদের এই টুলটির যথাযথ ব্যবহার কীভাবে করা যায়, তা বুঝতে শিশুদের সাহায্য করুন।
দৈনিক দেশজনতা/এন এইচ