আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
বিদেশি ত্রাণ-সহায়তা কর্মীদের প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অবিশ্বাসের কারণে মিয়ানমারের অভ্যন্তরের উদ্বাস্তু ও সহিংসতাপীড়িত রোহিঙ্গা মুসলিমদের জন্য ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় রাখাইন রাজ্যে সম্প্রতি সেনাবাহিনীর সহিংসতা শুরু হলে জীবন বাঁচাতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম দেশ ছেড়ে পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।
অন্যদিকে মিয়ানমারের ভেতরে আরও কয়েক লাখ রোহিঙ্গা অভ্যন্তরীণভাবে উদ্বাস্তু হয়ে সীমাহীন দুঃখ-কষ্ট ভোগ করছে। উদ্বাস্তু এই রোহিঙ্গাদের কাছে সাহায্য পৌঁছতে রীতিমতো সংগ্রাম করে চলেছে ত্রাণ-সহায়তা সংস্থাগুলো। রাখাইন রাজ্যের বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী সংস্থাগুলোকে রাখাইনে ঢুকতে দিচ্ছে না। সংস্থাগুলো স্থানীয় বৌদ্ধদের পক্ষ থেকে ব্যাপক বাধার মুখে পড়ছে। এক্ষেত্রে বৌদ্ধদের অভিযোগ, যুক্তরাষ্ট্র ও বিদেশি ত্রাণ-সহায়তা গোষ্ঠীগুলো শুধু মুসলিমদের সহায়তা করছে।
রয়টার্স জানায়, সাম্প্রতিক সহিংসতার পর ত্রাণ-সহায়তার ক্ষেত্রে মিয়ানমার সরকার ওই এলাকায় এ পর্যন্ত শুধু আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা রেডক্রসকে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে।
অন্যদিকে রাখাইন রাজ্যে জাতিসংঘ তার কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দিয়ে কর্মীদের সরিয়ে নিয়েছে। মিয়ানমার সরকারের অভিযোগ, সংস্থাটির কর্মীরা রোহিঙ্গা বিদ্রোহ উসকে দিয়েছে। রেডক্রস ওই এলাকার খারাপ আবহাওয়া, কঠিন ভূ-প্রকৃতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মধ্যদিয়ে রাখাইনে পৌঁছলেও স্থানীয় ক্ষুব্ধ বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর বাধার মুখে পড়ছে।
বৌদ্ধরা মনে করে, বিদেশি ত্রাণ-সহায়তা সংস্থাগুলো মিয়ানমারের সবচেয়ে দরিদ্র রাজ্য রাখাইনে রোহিঙ্গা বৌদ্ধদের দুর্ভোগকে অগ্রাহ্য করে।
বুধবার রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিত্তের ক্ষুব্ধ বৌদ্ধরা রাখাইনের সহিংসতাকবলিত এলাকাগামী একটি ত্রাণবাহী নৌকা আটকে দেয়। নৌকায় বোমা হামলা করে পুড়িয়ে দেয় তারা। তাদের হাতে লাটিসোটা, ধারালো ছুরি, পেট্রলবোম ছিল। এছাড়া রেডক্রসের ত্রাণবাহী একটি ট্রাকও আটকে দিয়ে তাতে তল্লাশি চালায় সিত্তের অধিবাসীরা। মিয়ানমারে মানবিক সহায়তা সমন্বয়বিষয়ক জাতিসংঘ কার্যালয়ের মুখপাত্র পিয়েরে পেরন বলেন, ‘রাখাইন রাজ্যের চলমান উত্তেজনার মধ্যে মানবিক ত্রাণ-সহায়তাকর্মী ও সংস্থাগুলো জীবন রক্ষাকারী কর্মকা- চালাতে গিয়ে ব্যাপক চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করছে।’
মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী ও সংঘবদ্ধ বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী একযোগে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর সহিংসতা শুরু করলে প্রাণ বাঁচাতে গত এক মাসে প্রায় ৪ লাখ ৩৬ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক সংস্থা ওই সহিংসতাকে জাতিগত নিধন বলে অভিহিত করেছে। বর্তমানে বিদেশি ত্রাণ-সহায়তা গোষ্ঠীগুলো একটি মানবিক দুর্যোগের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে বাংলাদেশকে সহায়তা বৃদ্ধি করেছে। পক্ষান্তরে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে একটি ভিন্ন ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে। যে সংকট এখন বহুমুখী হয়ে দেখা দিচ্ছে। সংকটগুলো সমাধান তো দূরের কথা, সাহায্য সংস্থাগুলোর সেখানে পৌঁছানোও এখন অসাধ্য হয়ে পড়েছে।
পিয়েরে পেরণ বলেন, ‘গত ২৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত যেসব মানবিক সহায়তা কর্মকান্ড চালু ছিল, সহিংসতার পর নতুন করে নিজেদের কর্মকা- তারা এখনও শুরু করতে পারেনি। রাখাইন রাজ্যের সব সম্প্রদায়ের দুস্থ লোকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর স্বার্থে এখনই জরুরি পদক্ষেপ নেয়া দরকার।’
রাখাইন রাজ্যের বেশ কয়েক লাখ জনগণের মধ্যে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বেশিরভাগই সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। অন্যদিকে পূর্বের ধর্মীয় দাঙ্গার কারণে উদ্বাস্তু হওয়া প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম রাজধানী সিত্তের কাছে শরণার্থী শিবিরে বন্দি জীবনযাপন করছে। বিদেশি সহায়তার ওপর নির্ভর করেই এতদিন বেঁচে রয়েছে এরা। তবে ২৫ আগস্টের পর এ সহায়তার সরবরাহ প্রায় বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। রাখাইন রাজ্য থেকে ৬ হাজারের মতো রোহিঙ্গা বৌদ্ধও সিত্তেয় পালিয়ে গেছে। তবে তাদেরকে কয়েকটি বৌদ্ধ আশ্রমে রাখা হয়েছে। মিয়ানমার সরকার ও রাখাইনের বৌদ্ধ স্বেচ্ছাসেবকরা তাদের ভালোমন্দ দেখাশোনা করছে।
রোহিঙ্গা বৌদ্ধরা বহুদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছে, বিদেশি সাহায্য সংস্থাগুলো অন্যান্য দরিদ্র জনগণকে অবহেলা করে শুধু মুসলিমদের উদারভাবে ত্রাণ দিচ্ছে। আরাকান ন্যাশনাল পার্টির (এএনপি) প্রধান তুন অং কিয়ো বলেন, ‘রাখাইনের সব লোকই দারিদ্র্যের যন্ত্রণা ভোগ করছে, কিন্তু শুধু মুসলিমরাই সাহায্য পায়।’ সিত্তের বৌদ্ধরা দাবি করেছে, জাতিসংঘ প্রাক্কলিত শরণার্থী সংখ্যা অতিরঞ্জিত এবং শরণার্থী শিবিরগুলোতে ত্রাণের কোনো ঘাটতি নেই। রাখাইনের একটি অধিকার গোষ্ঠী ‘রাখাইন আলিন দাগারে’র প্রধান কিয়ো সেইন বলেন, ‘তারা (মুসলিমরা) দরকারের চেয়ে বেশি ত্রাণ পায়।’ তিনি বলেন, তিনি স্থানীয় বাজারে রোহিঙ্গাদের তেল, চাল ও অন্যান্য ত্রাণসামগ্রী বিক্রি করতে দেখেছেন।
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ