শিল্প–সাহিত্য ডেস্ক:
জারি, সারি, ভাটিয়ালী, বাউল তথা লোকগীতি সম্ভবত বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় সঙ্গীত মাধ্যম। যে কোন অনুষ্ঠানে দেখা যায় সুরেলা কণ্ঠে গাওয়া কোন লোকগীতির পর দর্শক করতালি দিতে কার্পণ্য করেন না, গানের তালে তালে সমর্থনের ভঙ্গিতে মাথাও দোলান। তখন তাদের চেহারায় দেখা যায় গভীর ভাবমগ্নতা। কিন্তু এসব গানে যে জীবন দর্শন ফুটে উঠেছে, বিশেষ করে নারী পুরুষের সম্পর্ক বিষয়ে, তার বোধ বা গ্রহণযোগ্যতা আমাদের কাছে কতটুকু?
দীর্ঘদিন ধরে আমি এই বিষয়টা নিয়ে ভাবছি। এবার ইউকের(ইউনাটেড কিংডম) লিডস শহরে অনুষ্ঠিত সপ্তম রাধারমণ উৎসবে আমাকে এ নিয়ে আলোচনা করতে অনুরোধ জানানো হলে এই বিষয়ে আরো গভীর ভাবে ভাবার এবং কিছুটা পড়াশোনা করার সুযোগ হলো। যা জানতে এবং বুঝতে পারলাম তা নিঃসন্দেহে বিবেচনার দাবি রাখে।
বাংলা লোকগীতিতে, বিশেষ করে বাউল গানে, নারী পুরুষের যে প্রেমমগ্ন রূপ ফুটে উঠেছে তা এতোটাই জীবন্ত এবং স্পন্দনশীল, দৈহিক প্রেমের দর্শন এতোটাই গভীর এবং নিবিষ্টকারী যে এই বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হয়। এসব গানে নারী-পুরুষের প্রেমের সম্পর্ককে সকল ধর্মীয় বিধিনিষেধ, সামাজিক সীমাবদ্ধতা এবং জাগতিক বিষয়ের উর্ধ্বে স্থান দেয়া হয়েছে।
বাউল দর্শনের দৃষ্টিতে নারী-পুরুষের দৈহিক মিলন ঠিক ততটাই পবিত্র যতটা স্রষ্টা এবং তার সৃষ্টির বহু-আকাঙ্ক্ষিত মিলন। এসব গানে রাধা এবং কৃষ্ণের প্রেমের আকাঙ্ক্ষা ও ব্যাকুলতার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক প্রেমকেই রূপায়িত করা হয়েছে।
‘বাউল’ শব্দটার সাধারণ অর্থ হচ্ছে ‘পাগল’। অনেক বাউল নিজেদেরকে ‘ঈশ্বর প্রেমে পাগল’ বলে দাবি করেন এবং তাদের গানে নারী-পুরুষের দৈহিক মিলন, প্রেম-কলহ এবং বিরহের মাধ্যমে ঈশ্বর প্রেমের নানান রূপকে তুলে ধরেন। বাউল দর্শন অনুযায়ী ঈশ্বর বাহ্যিক জগতে, বিশেষ করে মানব দেহে, অবস্থান করেন। এই দর্শন অনুযায়ী একজন নারীসঙ্গীর উপস্থিতি এবং যৌনতাকে চূড়ান্ত আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার সোপান হিসেবেই দেখা হয়।
ঈশ্বর নারী-পুরুষের যৌন নির্যাসের মধ্যেই উপস্থিত থাকেন এবং মনে করা হয় যৌন মিলনের সময়ই এই নির্যাস সবচেয়ে বেশি ঐশ্বরিক এবং শক্তিশালী রূপ ধারণ করে, কারণ স্রষ্টার সৃষ্টিশীলতাকে মানুষ এই সময়েই সবচেয়ে বেশি অনুভব করতে পারে। একটি প্রচলিত বাউল বিশ্বাস হচ্ছে ‘যা দেহে নেই, তা জগতে নেই’।
প্রশ্ন উঠতে পারে নারী-পুরুষের সমান সামাজিক অধিকার ও গুরুত্ব আদায়ের জন্য আন্দোলনরত একজন নারীবাদী হিসেবে আমার জন্য লোকগীতির প্রশংসা করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? কারণ, এসব গানে আপাতদৃষ্টিতে নারীকে দেখা যায় কোন পুরুষের প্রেমের জন্য ব্যাকুল একজন অবলা প্রেমিকা রূপে যে পুরুষ তাকে ভুলে গেছে অথবা ফেলে গেছে এবং সম্ভবত আর কখনোই ফিরে আসবে না। যেমন, এই গানটিতেঃ ‘আমি কৃষ্ণ কোথায় পাই গো/ কৃষ্ণ কোথায় পাই গো/ বল গো সখি কোন দেশেতে যাই/ আমি কৃষ্ণ প্রেমের কাঙ্গালিনী নগরে বেড়াই গো’।
কিন্তু গভীর অভিনিবেশ দিয়ে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে বাস্তবতাকে তুলে ধরার পাশাপাশি নারীপুরুষ উভয়ের যৌন চাহিদাকে স্বীকৃতি দেয়ার মাধ্যমে এসব গানে নারীকে পুরুষের সমকক্ষ হিসেবেই দেখানো হয়েছে। নিজের যৌন চাহিদা সম্পর্কে সচেতনতার জন্য বা তা পূরণের ব্যাকুলতার জন্য নারীকে অভিশপ্ত করা হয়নি। রাধাকে বিভিন্ন গানে ‘কলঙ্কিনী’ বলা হলেও তা সমালোচনা নয় বরং সহমর্মিতার দৃষ্টিতেই করা হয়েছে।
যে নারী তার প্রেমিক পুরুষের সঙ্গ কামনা করে তাকে সমাজ কলিঙ্কিনী বলে আখ্যায়িত করে, এই সত্যটি তুলে ধরার মাধ্যমে এসব গানে নারীর প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন করা হয়েছে। যেমন, এই গানে: ‘অষ্ট আঙ্গুল বাঁশের বাঁশি/ মধ্যে মধ্যে ছেদা/ নাম ধরিয়া ডাকে বাঁশি/ কলঙ্কিনী রাধা’।
লেখক জুন মেকডেনিয়েল ১৯৯২ সালে প্রকাশিত তার ‘The Ebodiment of God among the Bauls of Bengal’ নামক নিবন্ধে বাউল দর্শনে নারীর অবস্থান সম্পর্কে একটি চমৎকার তথ্য তুলে ধরেছেন। নারীর মাসিক রক্তশ্রাবকে বেশিরভাগ ধর্ম এবং সমাজে একটি অপবিত্র বিষয় বলে মনে করা হয় যার ফলে এই সময়ে মেয়েরা সব ধরনের প্রার্থনায় অংশ নিতে পারে না। অথচ বাউল দর্শনে মাসিক রক্তশ্রাবকে নারীর সীমাহীন প্রাকৃতিক শক্তির উচ্ছ্বসিত প্রবহণ হিসেবে দেখা হয়।
বাংলা লোকগীতি আমাদের গ্রামগঞ্জের মেয়েদের কিছু গভীর কষ্টকে কতটা সহমর্মিতার সাথে তুলে ধরেছে তা আমি প্রথম নিবিড়ভাবে অনুভব করেছিলাম বছর দুয়েক আগে আমার এক ইংরেজ সহকর্মীর বাসায় একটা পার্টিতে গিয়ে। সেখানে নানান দেশের অতিথিরা নিজেদের দেশের গানের সাথে নানা রকম নাচ দেখাচ্ছিলেন। আমাকে বাংলাদেশী নাচ দেখানোর অনুরোধ করলে আমি বিপদে পড়ে গেলাম।
সিলেটি ধামাইল নাচ ছাড়া আর কোন নাচই আমি পারি না। তখন বাউল আব্দুল করিমের ‘বন্দে মায়া লাগাইছে/ দেওয়ানা বানাইছে’ গানটি বাজিয়ে আমি এবং আমার স্বামী ধামাইল নাচতে শুরু করলাম, আমাদের সাথে স্বতস্ফুর্তভাবে যোগ দিলেন উপস্থিত সকল ভিনদেশী অতিথিরা। নাচ শেষ হলে তারা গানের কথাগুলো বুঝতে চাইলেন। অনুবাদ করতে গিয়ে আগে অজস্রবার শোনা এই গানটির কথাগুলোর গভীরে প্রবেশ করলাম প্রথমবারের মত।
গানগুলোতে নারী পুরুষের প্রেমের মধ্যে দিয়ে বস্তুতপক্ষে সেইসব নারীদের কষ্টের কথা উঠে এসেছে যাদেরকে খুব অল্পবয়সে কোন অপরিচিত, অনেক সময় বাপ বা দাদার বয়েসী, পুরুষের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয় এবং ঘরের চারদেয়ালের মধ্যেই কাটে তাদের সমস্ত জীবন। সত্যিকারের ভালবাসার সন্ধান পাওয়ার সুযোগ তাদের জীবনে প্রায় কখনোই ঘটে না বললেই চলে। তবে ব্যতিক্রমও ঘটে যায় কখনো সখনো।
বটতলায় পশুপালনরত কোন রাখালের বাঁশি শুনে, অথবা বর্ষাকালে নৌকা করে আলতা চুড়ি টিপের পসরা নিয়ে দূর দেশ থেকে আসা কোন সওদাগরের মনভুলানো কথা শুনে প্রেমভাব জেগে উঠে কোন কূলবধূর প্রাণে। গতানুগতিক জীবনের একঘেয়েমি কাটিয়ে এসব ভিনদেশীদের প্রেমে পড়ে হয়তো কেটে যায় কূলবধূটির জীবনের কিছু অভিনব সুখের মুহূর্ত। কিন্তু তারপর আসে বিরহ। বাণিজ্যান্তে প্রেমিক পুরুষ তাকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে ফিরে আসার বিশেষ কোন সম্ভাবনা না রেখেই নিজের পথে চলে যায়।
‘কে বাজাইয়া যাওরে বাঁশি রাজপথ দিয়া
মনে লয় তার সঙ্গে যাইতাম কুলমান ছেদিয়া’।