নিজস্ব প্রতিবেদক:
রানা প্লাজা ধসে হাজারের বেশি শ্রমিক নিহতের ঘটনায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়। পোশাক রপ্তানি সাময়িকভাবে কমে যায়। কর্মপরিবেশ উন্নয়নে উদ্যোক্তাদের কোটি কোটি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। এ ধরনের নানা চ্যালেঞ্জ ও প্রতিকূলতার মধ্যেও দেশে তৈরি পোশাক কারখানার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। বছরে গড়ে দেড় শতাধিক কারখানা উৎপাদনে আসছে। তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ জানিয়েছে, ২০১৩ সালের এপ্রিলে সাভারে রানা প্লাজা ধসের পর গত প্রায় পাঁচ বছরে ৭২৩টি নতুন কারখানা বিজিএমইএর সদস্যপদ নিয়ে পোশাক রপ্তানি করছে। এর মধ্যে নতুন উদ্যোক্তারা সাড়ে পাঁচ শর বেশি কারখানা স্থাপনে বিনিয়োগ করেছেন। পুরোনো উদ্যোক্তারা বাকি কারখানাগুলো করেছেন। বর্তমানে সংগঠনটির সদস্যসংখ্যা ৪ হাজার ৪৮৬।
কয়েকজন পোশাকশিল্পের মালিক বলেছেন, নানা চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশে অন্য যেকোনো খাতের চেয়ে পোশাকশিল্প সম্ভাবনাময়। তা ছাড়া ব্যাংকগুলো পোশাকশিল্পে ঋণ দিতে নিরাপদ বোধ করে। সরকারও সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। তাই পোশাক কারখানার সংখ্যা বাড়ছে। পুরোনো কারখানাও সম্প্রসারিত হচ্ছে। তবে কারখানার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় পোশাকের মূল্য নিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হচ্ছে। এদিকে কারখানার সংখ্যা বাড়লেও পোশাক রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বাড়েনি। বরং কমেছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ২ হাজার ৪৪৯ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানির বিপরীতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ। পরের দুই অর্থবছর প্রবৃদ্ধি কমে যথাক্রমে ৪ ও ১০ শতাংশ হয়। সর্বশেষ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২ হাজার ৮১৪ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ২০ শতাংশ।
উৎপাদনে আসা নতুন ৭২৩ পোশাক কারখানার মধ্যে ২০১৩ সালে এসেছে ১৪১টি। তারপরের বছর ২১২টি কারখানা উৎপাদনে আসে, যা গত ৩৯ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ১৯৯২ সালে সর্বোচ্চসংখ্যক ২৩১ কারখানা চালু হয়েছিল। এ ছাড়া ২০১৫ সালে ১৩৭টি, গত বছর ১৩৬টি এবং চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৯৭টি পোশাক কারখানা চালু হয়েছে। অবশ্য নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর হিসাব আমলে নিলে নতুন কারখানার সংখ্যা আরও বাড়বে। সংগঠনটি জানিয়েছে, গত চার বছরে ২২৩টি কারখানা উৎপাদনে এসেছে। এসব কারখানার মধ্যে নিট পোশাক ও সরঞ্জাম কারখানা, এমনকি বায়িং হাউসও অন্তর্ভুক্ত আছে। অনেকগুলোর আবার বিকেএমইএর পাশাপাশি বিজিএমইএর সদস্যপদ আছে।
এদিকে প্রতিবছর নতুন কারখানা যেমন হচ্ছে, তেমনি পুরোনো কারখানা বন্ধও হচ্ছে। গত বছর বিজিএমইএ জরিপ করে দেখেছে, ১ হাজার ৩০১টি পোশাক কারখানা বন্ধ রয়েছে। বিজিএমইএর একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন বেশ কয়েক বছরে বন্ধ হওয়া এসব কারখানার অধিকাংশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি। কিছু কারখানা আবার নামে থাকলেও বাস্তবে ছিল না। জানতে চাইলে বিজিএমইএর সহসভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, ‘নতুন কারখানা পোশাকশিল্পের জন্য নেতিবাচক নয়, পুরোটাই ইতিবাচক। তবে নতুন পোশাক কারখানার পাশাপাশি পশ্চাৎমুখী শিল্প পর্যাপ্ত পরিমাণে হতে হবে। কিন্তু সেটি হয়নি। যেমন গত পাঁচ বছরে বস্ত্র খাতে নতুন মিল এসেছে মাত্র ১৭টি। এমনটি হলে পুরো বিষয়টি আর ইতিবাচক থাকে না। ‘পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার অনেকগুলো কারণ আছে। বৈশ্বিক চাহিদা কমে গেছে, ক্রেতারাও আগের চেয়ে কম দাম দিচ্ছেন। তা ছাড়া রানা প্লাজা ধসের পর আমাদের পোশাকশিল্প রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তাই নতুন কারখানার সঙ্গে প্রবৃদ্ধি কমার বিষয়টি মেলানো যুক্তিযুক্ত হবে না।’
রানা প্লাজা ধসের পর পোশাকশিল্পের কর্মপরিবেশ নিয়ে সারা বিশ্বে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়। কর্মপরিবেশ উন্নয়নে ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স গঠিত হয়েছে। সে জন্য ২০১৩ সালের পর যেসব কারখানা উৎপাদনে এসেছে, তাদের অধিকাংশই কমপ্লায়েন্ট কারখানা। পঞ্চাশের বেশি পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানাও এরই মধ্যে উৎপাদনে এসেছে। মো. আক্তারুজ্জামান তুরাগ এলাকায় গত বছর পনেরো কোটি টাকা বিনিয়োগে ইনট্রাস্ট ফ্যাশনস লিমিটেড নামে পোশাক কারখানা চালু করেন। কমপ্লায়েন্ট বা উন্নত কর্মপরিবেশের এই কারখানায় ৫০০ শ্রমিক কাজ করেন। মাসে গড়ে দেড় লাখ মার্কিন ডলারের পোশাক রপ্তানি করছে ইনট্রাস্ট। আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘২০১২ সালে কারখানা করার পরিকল্পনা করি। গত বছর চালু করেছি। তবে ক্রয়াদেশের অবস্থা খুবই খারাপ। এখন পর্যন্ত উৎপাদন সক্ষমতা অনুযায়ী ক্রয়াদেশ পাচ্ছি না।’ তিনি বলেন, ‘গত পাঁচ বছরে পোশাকের দাম অনেক কমিয়ে দিয়েছেন ক্রেতারা। এ ছাড়া কোনো ক্রেতা প্রতিষ্ঠান লিড বায়ার হতে চাইছে না। ফলে ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড বা অ্যালায়েন্স দিয়ে কারখানা পরিদর্শন করতে পারছি না। সে জন্য বাধ্য হয়ে অ্যাকর্ড বা অ্যালায়েন্সের সদস্য নয় এমন ক্রেতার কাজ করতে হচ্ছে।’
এদিকে জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, নতুন কারখানা চালু হওয়ায় উৎপাদন সক্ষমতা বেড়েছে। এটি খুবই ইতিবাচক। তবে পোশাকের ক্রয়াদেশ খুব একটা বাড়েনি। এ জন্য পোশাকের দাম নিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়েছে। ক্রেতারাও মজা পেয়ে গেছে। তারা অন্যায্যভাবে কম দাম দিচ্ছে। এটি বন্ধ করা না গেলে ভবিষ্যতে খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হতে পারে।
দৈনিকদেশজনতা/ আই সি