রাজু আহমেদ
বিছানার চাদর যিনি আবিষ্কার করেছেন তাকে পেলে খানিকটা আদর নিশ্চয় করতাম ! কেননা বিছানার এ বস্তুটির সাথে আমার কখনোই বন্ধুত্বপূর্ণ সংখ্য গড়ে ওঠেনি। আমি কোন বিছানায় শুয়েছি আর সে বিছানার চাদর ঠিকঠাক রয়েছে এমনটা ঘটেছে বলে মনে পড়ে না। আমার এ অভ্যাসটি নিশ্চয়ই বদ অভ্যাস। তারপরেও এটা কেবলমাত্র আমার ব্যক্তিগত শৃঙ্খলা নষ্ট করে। আপাতত অন্য কারো বিরক্তির কারণ হচ্ছে বলে প্রতীয়মান নয়। ব্যক্তিগত শৃঙ্খলাভঙ্গ শুধু ব্যক্তিকে ভোগায় কিন্তু জাতীয় শৃঙ্খলাভঙ্গ হলে সে ভোগ সার্বজনীন রূপে প্রকাশ পায়।
অথচ এই আমার দ্বারাই যদি বাস কিংবা অন্যকোন পথের যাত্রার দু’জনের আসনওয়ালা কোন সংযুক্ত বেঞ্চ কিংবা চেয়ারের সিংহভাগ দখল হয়ে যায় তখন নিশ্চয়ই সহযাত্রীর যাত্রায় বিঘœ ঘটবে। পাবলিক টয়লেট ব্যবহার করেছেন কখনো ? আমরা অনেক সময় দূরে কোথাও পাবলিক টয়লেট ব্যবহার করি। আচ্ছা, যদি ভাবি এ টয়লেটে তো আর দ্বিতীয়বারের জন্য প্রবেশ করা হবে না, কাজেই সময় নষ্ট করে পর্যাপ্ত পানি দেয়ার দরকার কি ? এসব ভাবলে কিংবা করলে তাতে আপনাকে কেউ হয়ত আটকাবে না কিন্তু আপনার পূর্বে যিনি টয়লেট ব্যবহার করে গেছেন তিনিও যদি আপনার অনুরূপ ভেবে একই কাজ করে যান আর আপনি যদি মোটামুটি মানুষ কিসিমের হন তবে সে টয়লেট ব্যবহার করার রুচি কি আপনার হবে ? এবার আপনার স্থানে আপনার পরবর্তীজনের দূর্ভোগ কল্পনা করে আপনার বিবেককে বিচারকের স্থানে বসান। বলুন, কি করা উচিত আর কি উচিত নয় । যাত্রী ছাউনিতে বসে যাত্রীরা অনেক সময় কিছু না কিছু খায়। এর উচ্ছ্বিষ্টাংশ যদি সবাই যেখানে সেখানে নিক্ষেপ করে তবে তা হাঁটুসম হতে কতক্ষণ ? এসব কি আর মানুষের ব্যবহার উপযোগী থাকবে ?
মাত্র সেদিন যখন আমি দৈহিক আকৃতি ও মানসিক বয়সে বেশ বড়সর, আইন বিভাগের একজন শ্রদ্ধেয় স্যারের সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলাম, যত্রতত্র কফ/থুতু ফেলব না; প্রয়োজনে খেয়ে নিব, তারপরেও না। সেদিনের পর থেকে মানুষের ব্যাঘাত সৃষ্টি করে কিংবা দৃষ্টিকটূ হয় এমন কোন জায়গায় কফ ফেলা হয়নি। এতে যে কফ গলধঃকরণ করতে হয়েছে ব্যাপারটা তাও নয় বরং কফ ফেলার জন্য যথেষ্ট উপযুক্ত জায়গা পেয়েছি। শুধু একটু সাবধানতা অবলম্বন করলেই হয়। আচ্ছা, আমরা কি আজ প্রতিজ্ঞা করতে পারি না যে, রুচিহীন পরিস্থিতির সৃষ্টি করে এমন কোন জায়গায় জীবনে আর কোন দিন কফ ফেলব না-পারিনা ? অনরূপভাবে, যা সব দৃষ্টিকটু হয়, মানুষের ভোগান্তি সৃষ্টি করে তাও এড়িয়ে চলতে পারিনা ? যদি মানুষ দাবী করি, তবে পারা উচিত।
আমরা প্রত্যহ পার্কে যাই, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই, অফিস-কর্মস্থলে যাই-এসব জায়গাগুলোর সৌন্দর্য অটুট রাখা ও বৃদ্ধি করার দায়িত্ব কার ? এসব সম্পদ কাদের ? আমরা যদি এসব নোংরা করে ফেলি, ফুলের বাগান নষ্ট করি, যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা রাখি-তার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত কি পরদেশী কেউ হচ্ছে? ভাবছি, বাসা থেকে দূরের কোথাও খোলা যায়গায় ময়লা ফেলে এসেছি বলে আমি তো ক্ষতির কবল থেকে রক্ষা পেলাম ! আসলেই কি রক্ষা পাচ্ছি ? আমার মত আরও অনেকের চিন্তার সমন্বয়ে যখন শহর-নগরের অলিগলি ময়লা-আবর্জনার ভাগাড় হচ্ছে তখন তার দুর্গন্ধ দিকে দিকে অনিষ্টতার মিছিল করছে। বাতাসের সাথে মিশে তা আবার আমাকেই গ্রহণ করতে হচ্ছে। শেষমেষ ক্ষতিটা কার হচ্ছে ? হয় আমার নয়তো আমার সন্তানের। ক্ষতিগ্রস্তের সীমাটা আমাতে-আপনাতেই সীমাবদ্ধ। দূরের কোন শত্রুর নয়।
আমরা হয়ত বছরে মাত্র দু’এক দিনের জন্য ট্রেন, স্টিমার, বাসে যাতায়াত করি। কাজেই এসব একটু নোংরা করলে দোষ কি ? একবার ভাবুন, এসব যানের কোনটাই কি কোনদিন বন্ধ থাকে ? আপনি আমি যাতয়াত করছি না বটে, কিন্তু কেউ না কেউ ঠিকই করছে। সবাই যদি এগুলোকে নিজেদের সম্পদ ভেবে ব্যবহার না করি তবে পরিনামে ক্ষতি কাদের হবে ? ট্রেন ভারত থেকে ক্রয় করেছি বলে নিশ্চয়ই ক্ষতি ভারতবাসীর হবে না বরং আমাদের সম্পদের যদি আমরাই ক্ষতির কারণ হই, তবে খেসারত আমাদেরকেই দিতে হবে। বাড়তি ভোগান্তি মিলবে বোনাস হিসেবে।
সৌন্দর্য মনে থাকে নাকি বস্তুতে সে বিতর্কে যাওয়ার সময় এটা নয়। তবে সৌন্দর্য উপলব্ধিতে মন এবং বস্তু-উভয়ের অবদান স্বীকার্য। কাজেই আমাদের চারপাশ যদি আমরাই গুছিয়ে না রাখি তবে আমাদের রুচির সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। আমরা সেই আমলের বাসিন্দা নই, যে আমলের মানুষকে লতা-পাতা দিয়ে লজ্জাস্থান আবৃত রাখতে হত। আমাদের চিন্তা ঢেড় এগিয়েছে। কাজেই এই সময়ে দাঁড়িয়েও যদি নিজেদের ভালো নিজেরা বুঝতে না পারি তবে সেটা নিশ্চয়ই বেদনার হবে। ক্লাস টু’য়ের একজন ছাত্রের দ্বারা যে আচরণের প্রকাশ ঘটে, সে আচরণ নিশ্চয়ই একজন অনার্স/মাষ্টার্স পাশ করা ব্যক্তির থেকে আশা করা যায়না। অশিক্ষিতের থেকে যে রুচিবোধ প্রকাশ পায়, একজন শিক্ষিতের থেকেও যদি তেমন কিছুর প্রকাশ মেলে, তবে আর শিক্ষায়-অশিক্ষায় কোন ব্যবধান থাকে কি ? শুধু গায়ে-গতরে বাড়লেই চলবে না, আমাদের মানসিকতায়ও বাড়তে হবে। আচরণ গুছিয়ে সভ্য-ভদ্র ও রুচিশীলতার প্রকাশ ঘটাতে হবে। বিস্তৃত করতে হবে উদারনৈতিক চিন্তাকে। সবকিছুতে ‘আমি’র বিলীন ঘটিয়ে ‘আমাদের’ ভাবতে হবে।
লেখক:কলামিষ্ট।