২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | বিকাল ৪:৫৩

রাজনৈতিক বিবেচনায় উপাচার্য নিয়োগ: ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম

নিজস্ব প্রতিবেদক:

দেশের উত্তরাঞ্চলে উচ্চশিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০০৮ সালে রংপুরে প্রতিষ্ঠা করা হয় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি)। কিন্তু প্রতিষ্ঠার প্রায় এক দশক পার হতে চললেও শিক্ষা ও গবেষণায় উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা নেই বিশ্ববিদ্যালয়টির। উল্টো উপাচার্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের আন্দোলনে বড় একটি সময়জুড়ে ব্যাহত হয়েছে বেরোবির শিক্ষা কার্যক্রম।

শুধু রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় নয়; বিভিন্ন সময়ে উপাচার্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় এবং নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যায়ের শিক্ষকদেরও। শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রমের চেয়ে উপাচার্যবিরোধিতা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠায় স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে এসব বিশ্ববিদ্যালয়েও। নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতা ও দক্ষতার চেয়ে রাজনৈতিকসংশ্লিষ্টতা বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া উপাচার্যদের অনেকেই ঠিকমতো বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতে পারেন না বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষাবিদগণ। এ প্রক্রিয়ায় নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্য সবসময়ই বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয়করণ ও নিয়োগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনিয়মে জড়িত থাকেন। ফলে তাদের নেতৃত্বে শিক্ষার মান বজায় রাখা সম্ভব হয় না।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রে একাডেমিক ও প্রশাসনিক দক্ষতাকে প্রাধান্য দেয়া উচিত। শুধু রাজনৈতিক পরিচয়ে নিয়োগ দিলে এর কুফল ভোগ করতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়কে। এছাড়া উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে স্থানীয় রাজনীতিবিদরাও প্রভাব রাখার চেষ্টা করেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও সৎ ও দক্ষ উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকার ইউজিসির পরামর্শ নিতে পারে।

সম্প্রতি বেরোবির তৃতীয় উপাচার্য হিসেবে চার বছরের মেয়াদ শেষ করলেও উপাচার্য অধ্যাপক ড. একেএম নূর-উন-নবীকে দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ মাথায় নিয়ে মধ্যরাতে পুলিশ পাহারায় ক্যাম্পাস ছাড়তে হয়। উপাচার্য হিসেবে দায়িত্বকালে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষকদের অনাস্থা ও আন্দোলনের মুখে পড়তে হয়েছিল তাকে। অনেক সময় শিক্ষকরা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন করেন। এর প্রভাব পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে সার্বিক শিক্ষা কার্যক্রমে।

দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রমাণ মেলায় বেরোবির আগের উপাচার্য মু. আবদুল জলিলকেও চার বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার একদিন আগে অপসারণ করা হয়।

প্রতিষ্ঠার ১০ বছরেও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির একাডেমিক উন্নয়নে খুব একটা ভূমিকা রাখতে পারেননি রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া এসব উপাচার্য। ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, আট হাজারের অধিক শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়টির গ্রন্থাগারে বই রয়েছে মাত্র ৪ হাজার ২৫০টি। সে হিসাবে শিক্ষার্থীপ্রতি একটি বইও নেই গ্রন্থাগারটিতে। এছাড়া প্রতিষ্ঠার পর থেকে বার্ষিক বাজেটে গবেষণা খাতে কোনো অর্থ বরাদ্দ দেয়নি রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়।

অবৈধ নিয়োগ-বাণিজ্য সিন্ডিকেট ও স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ বেশ কয়েকটি দাবিতে গত মার্চে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আলী আশরাফের বাসভবন অবরুদ্ধ করে রাখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নেতারা। আন্দোলনের প্রক্রিয়ায় গত ৭ মার্চ উপাচার্যকে অবাঞ্ছিত ঘোষণাও করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি।

এর আগে গত বছর ফেব্রুয়ারিতে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) শিক্ষক সমাজের পক্ষ থেকে উপাচার্য এম. অহিদুজ্জামান চাঁনের বিরুদ্ধে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশে অনিয়ম, আর্থিক অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার একাধিক অভিযোগ আনা হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে এ-সংক্রান্ত লিখিত অভিযোগ পাঠানো হয়। এর পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে একটি কমিটি গঠন করা হয়। তার বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম, শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ তদন্তের সিদ্ধান্ত নেয় ইউজিসি। গত বছরের ২৭ এপ্রিল ইউজিসির কমিটি সন্ত্রাসীদের মহড়ার কারণে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে পারেনি।

অভিযোগ রয়েছে, অহিদুজ্জামান চাঁনের একাডেমিক কার্যক্রমের চেয়ে তার রাজনৈতিক পরিচয়ই সেখানে মুখ্য। শিক্ষক হলেও সবকিছু ছাপিয়ে তার রাজনৈতিক পরিচয় সামনে চলে আসে। উপাচার্য হলেও তার মধ্যে রাজনৈতিক নেতার ছাপ দেখতে পান তার সহকর্মী ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। রাজনৈতিক ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়েই ইউজিসির তদন্ত দলকে ক্যাম্পাসে প্রবেশ থেকে বিরত রাখা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে এ উপাচার্যের বিরুদ্ধে।

সার্বিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে উচ্চমানে নিয়ে যাওয়ার জন্য উপাচার্য পদটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই উপাচার্য নিয়োগ দিতে হবে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে। অথচ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় উপাচার্য নিয়োগ দেয়া হয় দলীয়ভাবে, যা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়। শিক্ষক নিয়োগেও একই অবস্থা। নিয়োগ ও নিয়োগের পর পদায়নের ক্ষেত্রে আগে গবেষণা ও উচ্চতর ডিগ্রির প্রয়োজন হলেও এখন আর তার প্রয়োজন পড়ছে না। সবকিছুই হচ্ছে দলীয়ভাবে, যা গবেষণাকে নিরুত্সাহিত করছে।

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বিষয়টি উঠে এসেছে আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের (এআইবিএস) এক প্রতিবেদনেও। ‘উচ্চশিক্ষায় কৌশলগত ব্যবস্থাপনা ও কার্যকর নেতৃত্ব’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনায় সরকার ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপকে বড় ধরনের সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এটি যে স্বাভাবিক বিষয়, তা স্বীকার করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অপ্রয়োজনীয় ও অযাচিত হস্তক্ষেপ বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা।

এম/এম

প্রকাশ :মে ১৩, ২০১৭ ৫:১৩ অপরাহ্ণ