২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সকাল ৯:১৭

সিন্ডিকেটের বেড়াজালে দিনাজপুরে অস্থির চালের বাজার

দিনাজপুর প্রতিনিধি:

ভারতসহ বিভিন্ন দেশে থেকে আমদানি ও পর্যাপ্ত মজুদ থাকা সত্ত্বেও ধানের জেলা খ্যাত দিনাজপুরসহ এই অঞ্চলে বেড়েই চলেছে চালের দাম। বাজারে অব্যাহতভাবে চালের দাম বাড়ার ব্যাপারে মিল মালিকদের কারসাজি ও সিন্ডিকেটকেই খুচরা ব্যবসায়ীরা দায়ী করছেন। আর মিল মালিকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম বৃদ্ধি ও আমদানি নির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় চালের দাম বেড়েছে। তবে  মিল মালিকরা ইচ্ছামতো দাম বাড়িয়ে বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে কিনা প্রশাসন তা খতিয়ে দেখে পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দিনাজপুরের মিলগুলোতে পর্যাপ্ত মজুদ থাকা সত্ত্বেও মিল মালিকরা গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে ৫০ কেজির প্রতি বস্তা চালের দাম ৩শ’ থেকে ৪শ’ টাকা বাড়িয়েছেন।

দিনাজপুরের খুচরা বাজারের চাল ব্যবসায়ীরা জানান, মিলগুলোতে চাল পাওয়া গেলেও তারা ইচ্ছামতো দাম নির্ধারণ করছেন। তারা জানান, এক সপ্তাহ আগে ৫০ কেজি ওজনের প্রতি বস্তা মিনিকেট চাল মিল মালিকরা বিক্রি করেছিল ২,৪০০ টাকা থেকে ২,৫০০ টাকা। মিল মালিকরা এখন তা বিক্রি করছে ২,৭৫০ থেকে ২,৮০০ টাকা। এক সপ্তাহের ব্যবধানে বিআর-২৮ চাল ২,৩৫০ টাকার স্থলে ২,৬০০ টাকা, স্বর্ণা ২,১০০ টাকার স্থলে ২,৩৫০ টাকা, হাইব্রিড মোটা ১,৮০০ টাকার স্থলে ২,২০০ টাকা এবং বিআর-২৯ চাল এক সপ্তাহের ব্যবধানে ২,৩০০ টাকার স্থলে ২,৫৫০ টাকায় বিক্রি করছে।

দিনাজপুর বাহাদুর বাজারের চাল ব্যবসায়ী লিয়াকত আলী জানান, মিলে চাল নেই- এমন কথা বলছেন না কোনো মিল মালিকই। তবে সব মিল মালিকই একসাথে দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। এ জন্য তাদের বাধ্য হয়েই বেশি দামে চাল বিক্রি করতে হচ্ছে। আর এতে তাদের ক্রেতাদের সাথে প্রায়ই বাক-বিতণ্ডা হচ্ছে। এদিকে পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও এই মুহূর্তে চালের দাম বৃদ্ধির কোনো যৌক্তিক কারণ নেই বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। যেসব ধান ব্যবসায়ী এবার বোরো মৌসুমে ধান কিনে মিল মালিকদের কাছে সরবরাহ করেছেন, তারা জানান, বোরো মৌসুমে পর্যাপ্ত ধান কিনে মজুদ করেছে মিল মালিকরা।

দিনাজপুরের বিরল উপজেলার ধান ব্যবসায়ী সোহরাব আলী জানান, তাদের কাছে বোরো মৌসুমে এবার ৭৫ কেজির প্রতিবস্তা মিনিকেট ধান ১,৭০০ টাকা, বিআর-২৮ ও বিআর-২৯ ধান ১,৬০০ টাকা এবং হাইব্রিড মোটা ধান ১,৫০০ টাকা দরে কিনেছে মিল মালিকরা। এই হিসাবে মিলের উৎপাদন খরচসহ প্রতিকেজি মিনিকেট চাল ৩৬ টাকা, বিআর-২৮ ও বিআর-২৯ চাল ৩৩ টাকা এবং প্রতিকেজি হাইব্রিড মোটা চাল ৩০ থেকে ৩২ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বর্তমানে মিল মালিকদের কাছ থেকে চাল ব্যবসায়ীদের বস্তার হিসাব অনুযায়ী প্রতিকেজি মিনিকেট চাল ৫৫ টাকা, বিআর-২৮ ও বিআর-২৯ চাল ৫১ টাকা এবং হাইব্রিড মোটা চাল কিনতে হচ্ছে ৪৫ টাকা কেজি দরে। মিল মালিকরা তাদের বাজার থেকে ধান কেনা ও উৎপাদন খরচ ধরে বস্তার হিসাব অনুযায়ী প্রতিকেজি চাল গড়ে প্রায় ২০ টাকা বেশি দরে বিক্রি করায় বাজারে অস্বাভাবিকহারে বেড়েছে চালের দাম।

খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান, তারা মিলগুলোতে চাল কিনতে গিয়ে ব্যাপক মজুদ লক্ষ করেছেন। তারা জানান, মিলগুলোতে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করলে চালের বাজার অনেকটাই স্বাভাবিক হতে পারে। সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে সাম্প্রতিক বন্যা, রোহিঙ্গা ইস্যু এবং ভারত চাল রফতানি করবে না এমন গুজবে অধিক মুনাফার আশায় ইচ্ছমতো চালের দাম বৃদ্ধি করেছে মিল মালিকরা। আর এর প্রভাব খুচরা বাজারে পড়েছে।

সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দাম বৃদ্ধির অভিযোগ অস্বীকার করে দিনাজপুর জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সভাপতি মোসাদ্দেক হুসেন জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণেই বেড়েছে চালের দাম। এক্ষেত্রে মিল মালিকদের কোনো কারসাজি নেই। মিলে মজুদ থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ মিল মালিকরা প্রতিবস্তা চালের দাম ৩শ’ থেকে ৪শ’ টাকা বৃদ্ধি করল কেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমদানি মূল্য বেড়ে যাওয়ায় বেড়েছে চালের দাম। তিনি জানান, মিলে যে পরিমাণ ধান রয়েছে- তা স্বাভাবিক পর্যায়ে রয়েছে। একটি মিল চালাতে যেটুকু ধানের প্রয়োজন, সেটুকু ধানই রয়েছে মিলগুলোতে।

পর্যাপ্ত মজুদ থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ বাজারে চালের দাম বৃদ্ধিকে অযৌক্তিক উল্লেখ করে দিনাজপুর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কাওছার আলী জানান, চালের দাম বৃদ্ধির ব্যাপারে আগামী রোববার দিনাজপুর জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে একটি জরুরি সভা আহ্বান করা হয়েছে। সভায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে মিলগুলোতে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে। তিনি জানান, মিল মালিকরা অন্য কোথাও ধান মজুদ করে রেখেছে কিনা তাও দেখা হবে।

দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর সূত্রে জানা গেছে, সরকার চালের আমদানি শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ নির্ধারণ করায় হিলি স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে প্রচুর পরিমাণে চাল বাংলাদেশে আসছে। হিলি স্থলবন্দরের বেসরকারি অপারেটর পানামা পোর্ট লিংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপক অসিত কুমার সান্যাল জানান, হিলি স্থলবন্দর দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ভারত থেকে ১০০টি করে চাল বোঝাই ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। তাতে এই বন্দর দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার মেট্রিকটন চাল ভারত থেকে বাংলাদেশে আসছে।

হিলি স্থলবন্দরের কাস্টমস সুপারিনটেনডেন্ট মো. ফখর উদ্দীন জানান, এই বন্দরের মাধ্যমে ভারত থেকে আমদানি স্বাভাবিক রয়েছে। বরং ঈদের পর থেকে বেশি চাল আমদানি হচ্ছে। বন্দরে চাল বোঝাই ট্রাক আসার সাথে সাথে খালাস কার্যক্রমও সম্পন্ন করা হচ্ছে। যাতে ব্যবসায়ীরা দ্রুত চাল খালাস করে তাদের গন্তব্যে নিয়ে যেতে পারেন। এরপরও দিনাজপুরে এক সপ্তাহের ব্যবধানে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে চালের দাম। দিনাজপুরের সবচেয়ে বড় চালের বাজার বাহাদুরবাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এক সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিপ্রতি চালের দাম বেড়েছে ৬ থেকে ৮ টাকা।

এক সপ্তাহ আগে প্রতিকেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হতো ৫২ টাকা দরে। এখন বিক্রি হচ্ছে ৫৮ টাকা কেজি দরে। এ ছাড়া বিআর-২৮ চাল প্রতিকেজি ৪৮ টাকার স্থলে ৫৫ টাকা, স্বর্ণা ৪২ টাকার স্থলে ৪৭ টাকা, হাইব্রিড মোটা ৩৭ টাকার স্থলে ৪৪ টাকা, বিআর-২৯ চাল প্রতিকেজি ৪৬ টাকা থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৫২ টাকায়।

দৈনিকদেশজনতা/ আই সি 

প্রকাশ :সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৭ ১১:০৮ পূর্বাহ্ণ