২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১:৪৫

দিনাজপুরে আমন চারার জন্য কৃষকদের হাহাকার

নিজস্ব প্রতিবেদক:

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সরকার আমন চারা বিতরণসহ তাদের পুনর্বাসনের ঘোষণা দিলেও দিনাজপুরের কৃষকরা সে সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এ জেলার আমনক্ষেতের মাত্র দশমিক ৬৩ শতাংশ জমিতে রোপণের জন্য চারা ও বীজ বিতরণ করেছে সরকারি কৃষি বিভাগ।

চারা না পেয়ে জেলার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মধ্যে এখন বিরাজ করছে হাহাকার অবস্থা। এই অবস্থায় কেউ চড়া দামে চারা কিনে ক্ষতিগ্রস্ত জমিতে পুনরায় আমন রোপণের চেষ্টা করছেন। আবার কেউ কেউ নগদ অর্থের আশায় রোপণ করা জমির আমন চারা বিক্রি করে দিচ্ছেন। ফলে ধানের জেলা হিসেবে খ্যাত দিনাজপুরে এবার আমনের ফলন বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, সাম্প্রতিক বন্যায় দিনাজপুর জেলায় এবার সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট হয়েছে ২৫ হাজার ৪৫৬ হেক্টর জমির আমন ক্ষেত। আর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জেলার মোট ২ লাখ ৬ হাজার ৭০৯ জন কৃষক। ক্ষতিগ্রস্ত এসব কৃষকের মধ্যে ৭৫ হাজার ৯৩৭ জন প্রান্তিক এবং ৮১ হাজার ৪৭২ জন ক্ষুদ্র কৃষক। বন্যার পরপরই সরকার ক্ষতিগ্রস্ত এসব কৃষকদের পুনর্বাসন ও আমন চারা বিতরণের ঘোষণা দেয়। কিন্তু বন্যার পর দিনাজপুর জেলায় এ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক সরকারি এই সুযোগ তেমন পায়নি।

দিনাজপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক গোলাম মোস্তফা জানান, দিনাজপুর জেলায় মোট ১৩৩ হেক্টর জমিতে রোপণের জন্য ১ হাজার কৃষকের মধ্যে আমন চারা এবং ২৯ হেক্টর জমির জন্য ২২০ জন কৃষকের মধ্যে আমন বীজ বিতরণ করা হয়েছে।

সরকারি এই হিসাব অনুযায়ী, জেলায় মোট ২৫ হাজার ৪৫৬ হেক্টর জমির আমন ক্ষেত নষ্ট হলেও আমন চারা ও বীজ বিতরণ করা হয়েছে মাত্র ১৬২ হেক্টর জমিতে আবাদের জন্য। যা মোট ক্ষতিগ্রস্ত জমির শূন্য দশমিক ৬৩ শতাংশ। আর মোট ২ লাখ ৬ হাজার ৭০৯ জন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও আমন চারা ও বীজ পেয়েছে মাত্র ১ হাজার ২২০ জন কৃষক। যা মোট ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের মাত্র শূন্য দশমিক ৫৯ শতাংশ।

এদিকে দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, কৃষকরা তাদের ক্ষতিগ্রস্ত জমিতে পুনরায় আমন চারা রোপণের জন্য চড়াদামে আমন চারা সংগ্রহের চেষ্টা চালাচ্ছে। আবার কোনো কোনো কৃষক তাদের জমিতে রোপণকৃত আমন চারা নগদ অর্থের জন্য বিক্রি করে দিচ্ছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রোপণ জমির প্রতি বিঘা আমন চারা বিক্রি হচ্ছে ২৫ হাজার টাকা থেকে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত।

কৃষকরা জানান, এক বিঘা জমির রোপণকৃত চারা তুলে ৫ বিঘা থেকে ৮ বিঘা জমিতে আমন রোপণ করা যাচ্ছে। কেউ কেউ আবার একটি জমির রোপণকৃত চারা তুলে তা সমবণ্টনের মাধ্যমে তার অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত জমিতে রোপণ করছে। বিরল উপজেলার বিস্তইর গ্রামের কৃষক আনিসুর রহমান পাকো তার রোপণকৃত জমির আমন চারা তুলে বিক্রি করছেন।

তিনি জানান, তিনি ৫ বিঘা জমিতে এবার আমন রোপণ করেছেন। বন্যায় তার ক্ষেত তেমন ক্ষতিগ্রস্তও হয়নি। বন্যার পর আমন চারার ব্যাপক চাহিদা হওয়ায় তিনি তার ২৫ শতক জমির রোপণকৃত আমন চারা বিক্রি করেছেন সাড়ে ১১ হাজার টাকায়। তিনি বলেন, নগদ যা পেয়েছি- তাই লাভ। এই জমিতে তিনি আগাম আলু চাষ করবেন বলে জানান। পুরিয়া গ্রামের কৃষক বাবু ইসলাম জানান, তিনি তার এক একর জমিতে রোপণ করা আমন চারা বিক্রি করে দিয়েছেন ৫৫ হাজার টাকায়।

তিনি জানান, ধান আবাদ করে খরচ বাদ দিয়ে এই এক একর জমিতে ৫৫ হাজার টাকা পাওয়া কঠিন ছিল। কিন্তু না চাষ করেই যেটা পেয়েছেন-সেটাই তার লাভ। আর ওই এক একর জমিতে আমন ধানের পরিবর্তে আগাম রবিশষ্য আবাদ করবেন বলে জানান বাবু ইসলাম।

দিনাজপুর সদর উপজেলার সদরপুর গ্রামের কৃষক আরিফুল ইসলাম জানান, বন্যায় তার ২ বিঘা জমির রোপণকৃত আমন চারা সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক চেষ্টা করে আমন চারা সংগ্রহ করতে পারেননি তিনি। সরকারিভাবেও কোনো চারা পাননি। অধিকাংশ কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত জমিতে রোপণের জন্য চারা না পেয়ে বিভিন্ন স্থানে আমন চারার জন্য হন্যে হয়ে ছুটছেন। কোথাও পেলেও তা কিনতে হচ্ছে চড়া দামে।

বিরল উপজেলার গফুরাইল গ্রামের কৃষক নুরুল ইসলাম জানান, বন্যায় তার তিন বিঘা জমির আমন ক্ষেত সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়েছে। বাধ্য হয়ে কাহারোল উপজেলার জয়নন্দ এলাকা থেকে বাদশা ভোগ জাতের এক বিঘা জমির রোপিত আমন চারা কিনেছেন ৪০ হাজার টাকায়।

তিনি জানান, বন্যার আগে আমন চারা, চাষ, শ্রমিকসহ প্রতি বিঘা জমিতে আমন রোপণ করতে খরচ হয়েছে ৩ হাজার ৩’ শ টাকা। বন্যায় সেই আমন ক্ষেত সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। এখন বন্যার পর চারা কেনা, শ্রমিক মজুরি ও চাষসহ এক বিঘা জমিতে তার বাড়তি খরচ হয়েছে ৭ হাজার টাকা। ফলনও আগের মতো হবে না। জমিও ফেলে রাখা যায় না। এই টাকা তিনি তুলবেন কিভাবে এ দুশ্চিন্তায় আছেন। একই কথা জানালেন ওই গ্রামের কৃষক মামুন ইসলাম, জসিমউদ্দীনসহ অন্য কৃষকরা। এই অবস্থায় অনেকেই চারা না পেয়ে নষ্ট হয়ে যাওয়া অনেক জমি এখনও আবাদ করতে পারেননি।

অবশ্য জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক গোলাম মোস্তফা জানান, অধিকাংশ জমিতে আমন রোপণ করেছেন কৃষকরা। যেহেতু আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমন চারা রোপণের সময় আছে। সেহেতু এই সময়ের মধ্যে অবশিষ্ট জমিতে আমন রোপণ সম্পন্ন হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ

প্রকাশ :সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৭ ১২:২৯ অপরাহ্ণ