কক্সবাজার প্রতিনিধি: মিয়ানমারের জাতিগত সহিংসতার শিকার হয়ে সর্বস্ব হারিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে আশ্রয় নেয়া চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে রোহিঙ্গার দশ হাজারেরও বেশি শিশু। গত ২ সপ্তাহে অভূক্ত থেকে অসুস্থ্য হয়ে মারা গেছে অন্তত ১৫০ শিশু। বাড়ছে শিশুও। প্রসূতি মাও মারা গেছে দশ জন। ক্রমশঃ এ সংখ্যা বেড়েই চলছে। এই তথ্য জানা গেছে কুতুপালং এমএসএফ হাসপাতাল ও সীমান্তের বিভিন্ন মেডিকেল টিম থেকে প্রাপ্ত সূত্রে। অন্যদিকে মিয়ানমার থেকে আগত শিশুদের প্রাণঘাতি টিকা দেয়া নাই। তাই ব্যাপকহারে হাম রুবেলা, ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
অর্ধাহারে অনাহারে দূর-দূরান্ত থেকে আসা বিশেষতঃ নারী-শিশু-বৃদ্ধের দুঃখ দুর্দশাগ্রস্থ হাজার হাজার রোহিঙ্গাদের মাঝে তীব্র খাদ্য সংকট প্রকট আকার ধারন করছে। তাই ক্ষুধার্ত মা শিশুকে বুকের দুধ দিতে না পারায় হাড্ডিসার অবস্থা রোহিঙ্গা শিশুদের। গত কয়েকদিনে সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ঢুকে পড়া এসব রোহিঙ্গারা অনাহারে অর্ধাহারে ছুটছে অনিশ্চিত গন্তব্যে। ঢুকে পড়া এসব রোহিঙ্গারা সর্বত্রই গন্তব্যহীনভাবে এদিক সেদিক ছুটাছুটি করছে।
এই বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের খাদ্য সংকট ও তাদের শিশুদের মৃত্যুর সংখ্যা আশংকা জনকহারে বৃদ্ধি পাওয়ায় মানবিক বিপর্যয়ের আশংকাও করছে অনেকেই। সীমান্তের তিন উপজেলা টেকনাফ, উখিয়া, নাইক্ষ্যংছড়ির সড়ক মহাসড়ক কিংবা গ্রামের মেঠোপথে এখন রোহিঙ্গাদের ঢল। তারা প্রতিদিনই রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে কাদায় একাকার হয়ে জীবন নিয়ে তারা সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছে। তাদের সাথে থাকা শিশুরা অনাহারে-অর্ধাহারে খোলা আকাশের নিচে বৃষ্টিতে ভিজেছে এবং রোদে পুড়েছে। ক্ষুধার্ত মা শিশুকে বুকের দুধ দিতে না পারায় হাড্ডিসার অবস্থা রোহিঙ্গা শিশুদের। শত শত শিশুর জ্বরে পুড়ছে শরীর। কিন্তু কোলে নিয়ে বসে থাকা ছাড়া করার কিছু নেই হতভাগা মায়ের। তাছাড়া পানিবাহিত রোগ ডায়রিয়া, আমাশয়, নিমোনিয়ার প্রাদুর্ভাব সবখানে ছড়িয়ে পড়ছে। অনেক গর্ভবতী নারী সীমান্তের দূর্গম পথ পাড়ি দিতে গিয়ে অসময়ে সন্তান প্রসব করেছেন। নতুন আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ঠিকমত চিকিৎসা করার কোন সুযোগ নেই। কুতুপালং এমএসএফ হাসপাতালের স্বাস্থ্য সেবা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। খাদ্য সংকটাপন্ন অবস্থা মোকাবেলা করার পাশাপাশি চিকিৎসা সেবার উপর জোর দেয়া প্রয়োজন আন্তজার্তিক সম্প্রদায়ের। শরণার্থী শিবিরের এনজিও কর্মীরা জানিয়েছেন, তাদের জনবলের সংখ্যার চেয়ে বিপরেিত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় সাস্থ্য সেবা দেওয়া খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা শরণার্থী শিবিরের কাছাকাছি অবস্থান করছে তারা দেরীতে হলেও চিকিৎসা পাচ্ছে। কিন্তু যারা সীমান্তবর্তী গ্রামে এবং তাদের জিরো পয়েন্টে অবস্থান করছে বিনা চিকিৎসায় চরম স্বাস্থ্যহানী হচ্ছে।
রোহিঙ্গারা জানান, ত্রাণ বিতরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ত্রাণ দেয়ার পাশাপাশি যদি ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল টিম গঠন করে চিকিৎসা দেয় তবে অসুস্থ রোহিঙ্গাদের উপকার হবে। এদিকে মিয়ানমারে জাতিগত সহিংসতা থামার কোনো লক্ষণ নেই। প্রতিদিনই আরকানের রোহিঙ্গা অধ্যূাষিত কোন না কোনো গ্রামে আগুনের লেলিহান শিখা দেখা যাচ্ছে। শত শত ঘর বাড়ি পুড়ে ছাই হচ্ছে। প্রাণ বাঁচাতে তাই রোহিঙ্গারা খাল বিল নদী পার হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সীমান্তের নো ম্যান্স ল্যান্ডে জড়ো হচ্ছে। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে কাদায় একাকার হয়ে জীবন নিয়ে তারা সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছে।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগর পার হতে গিয়েও তারা লাশ হচ্ছে। রাতের বেলায় নৌকায় করে পালিয়ে আসার সময় প্রতিদিনই নৌকা ডুবির ঘটনা ঘটছে। নাফ নদী কিংবা টেকনাফ সমুদ্র উপকূলে প্রতিদিনই রোহিঙ্গাদের লাশ ভেসে আসছে। সৈকতে আচড়ে পাড়ছে নারী ও শিশুর লাশ।
কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফ এবং বান্দরবনের নাইক্ষ্যংছড়ির পুরো সীমান্তে জুড়েই হাজার হাজার রোহিঙ্গারা তাবু টাঙ্গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে দুই লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। হঠাৎ রোহিঙ্গাদের আগমনে অনেকেই হতবাক। হতবাক এখানকার প্রশাসন,আইন শৃংখলা বাহিনী, বিজিবি এবং জনপ্রতিনিধিরা। বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা শরনার্থী চাপে কক্সবাজার ও বান্দরবনসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় মানবিক বিপর্যয়ের আশংকাও করছে করছেন স্থানীয়রা। ইতিমধ্যে হাজার হাজার রোহিঙ্গাদের মাঝে তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। খাবারের জন্য তারা রাস্তায় এসে বসে আছে। কোনও গাড়ি দেখলেই ছুটে আসে। কোনও গাড়ি থেকে শুকনো খাবার দিতে দেখলে ওই খাবার সংগ্রহ করতে শুরু হয় তীব্র প্রতিযোগিতা। এই প্রযোগিতায় বৃদ্ধ ও শিশুদের প্রাণহানির শঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। দেশের মূল ভু-খন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন শাহপরীরদ্বীপে নাফনদী ও সাগর পাড়ি দিয়ে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের চরম খাদ্য সংকট চরম আকার ধারন করছে। সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের (সাবরাং ইউনিয়ন) সচিব শেখ ফরিদুল আলম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানিয়েছেন,গত ২৫ আগস্ট থেকে রাত-দিন হাজার হাজার রোহিঙ্গা শাহপরীরদ্বীপ পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশ করছে। এখনও তা অব্যাহত রয়েছে। শাহপরীরদ্বীপ মূল ভু-খন্ড থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন একটি ঐতিহাসিক এলাকা। গত কয়েক বছর ধরে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় নিত্য প্রয়োজনীয় মালামাল সহজে পরিবহন করা সম্ভব হচ্ছেনা। এমনিতেই শাহপরীরদ্বীপের মানুষ ধার্মিক ও অতিথি পরায়ণ হিসাবে সুনাম রয়েছে।
শাহপরীরদ্বীপের আবদুল হক জানান, অর্ধাহারে অনাহারে দুর-দুরান্ত থেকে আসা বিশেষতঃ নারী-শিশু-বৃদ্ধের দুঃখ দুর্দশায় সহমর্তিতা ও সহানুভুতি দেখিয়ে শাহপরীরদ্বীপের মানুষ যতটুকু সম্ভব আপ্যায়ণের মাধ্যমে মানবতা দেখিয়েছেন। এমনকি ফ্রিজে রাখা সাধের কুরবানীর সমস্ত মাংস রান্ন করে অনেকেই অভুক্ত রোহিঙ্গাদের মেহমানদারী করেছেন। বস্ত্রহীনদের কাপড় দিয়েছেন। গাড়ি ভাড়ার ব্যবস্থা করেছেন। এভাবে অব্যাহত থাকায় এবং সহজে সরবরাহের অভাবে বর্তমানে শাহপরীরদ্বীপে চরম খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। মুসলমান হিসাবে মানবিক কারণে সকলেই মেহমানদারী করতে ব্যস্ত। কিন্ত সে পরিমাণ পণ্য মজুদ নেই। সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় নিত্য প্রয়োজনীয় মালামাল সহজে পরিবহন করা সম্ভব হচ্ছেনা। চাল-ডাল তেল তরিতরকারীসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আকাশ ছোঁয়া। এমনকি ১ কেজি আলুর দাম ৫০ টাকার উপরে চলে গেছে।
উখিয়া পালংখালী বাজারে দোকানে দোকনে রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের খাবার চাইতে দেখা গেছে। ছেনোয়ারা বেগম (২৬) নামে এক রোহিঙ্গা নারী কোলে দুই সন্তান নিয়ে এই বাজারের হোটেল আল মদিনায় ভাত চান। সঙ্গে তার বৃদ্ধ শ্বশুর আব্দুর রাজ্জাকও ছিলেন। অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। হোটেলের মালিক সিরাজুল ইসলামের ছেলে মো. হোসেন ওই নারীকে একটি পলিপ্যাকে ভাত ও মাংস দিয়ে দেন। ছেনোয়ারা বলেন, ‘আমরা একই পরিবারের ১২ জন পালিয়ে বাংলাদেশে আসি। রাস্তায় আছি এখনও। বৃষ্টি হলে গাছের নিচে বসে থাকি।’
পথে কথা হয় ফরিদা বেগম (৪৫) নামে একজন নারীর সঙ্গে। তার স্বামীর নাম মৃত গোরামিয়া। তারা মিয়ানমারের মংডুর বলিবাজার এলাকায় থাকতেন।তার সাত ছেলে মেয়ে। চার ছেলে ও তিন মেয়ে। তাদের সবাইকে নিয়ে আমি অন্যাদের সঙ্গে বাংলাদেশে আসি। এর আগে ১৪ দিন আমরা নো-ম্যান্স ল্যান্ডে ছিলাম। তিনি কান্নজড়িত কণ্ঠে বলেন, তার মেয়েদের ধর্ষণ করেছে সেনারা। ছেলেদের হত্যা করেছে। মেয়েদের নিয়ে ভয়ে ছিলাম। তাই সবাইকে নিয়ে চলে এসেছে। বালুখালীর পাহাড়ে ফরিদা বেগম পলিথিন ও পাশ দিয়ে একটি ছোট্ট টংঘর বানিয়েছেন। বুধবার তিনি ভাত খেয়েছেন এরপর আর কিছু খাননি।
ওই পাহাড়েই আশ্রয় নিয়েছেন শাহানূর বেগম নামে একজন নারী। তিনি বলেন, তার স্বামী ইউনুছ আলীকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী গুলি করে হত্যা করেছে।
উখিয়ার কলাবাগানে আশ্রয় নেওয়া মাছুমা বেগম রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন। তার ছেলেমেয়ে নয় জন। খাবার নেওয়ার জন্য তারা রাস্তার ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন। খাইরুন নেসা (৪০) নামে এক নারী বলেন, ‘তার স্বামীর নাম হোসেন জোহুর। গাছের ব্যবসা করতেন মিয়ানমারে। এখন আর কিছুই নেই। এক কাপড়ে চলে আসি। প্রায় ১৫ দিন ধরে একই কাপড়ে আছি।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচারের কথা উল্লেখ করে সেনোয়ারা বেগম নামে আরেকজন বলেন, আমাদের বাড়ির ওপরে হেলিকপ্টার উড়ছে। এরপর আগুন দিয়েছে। তারপর গুলি করছে সবাইকে। তার বাবা-মা ও পাঁচ ভাই-বোনের কেউ বেঁচে নেই। সবাই মারা গেছে।
পালংখালী এলাকার আলমগীর আলম নিসা নামে এক তরুণ বলেন, ‘এখন করুণ অবস্থা দেখে অনেকেই এগিয়ে আসছেন। কিন্তু এত লোককে কে কতদিন খাবার দেবে। এত মানুষ কী খেয়ে বেঁচে থাকবে? শিশু ও বয়স্করা না খেয়ে ক’দিন থাকতে পারবে? এই এলাকার অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না। সবাই খেটে খায়। তার ওপর লাখ লাখ মানুষ আসায় এই অঞ্চলের স্থানীয় বাসিন্দারাও এখন বাজার থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাচ্ছেন না।
কক্সবাজারে আইওএম হেড অব সাব অফিসের কর্মকর্তা সংযুক্তা সাহনী জানান, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতন দমন-পীড়ন সহ্য করতে না পেরে এসব নির্যাতিত মুসলমানেরা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। দু-দেশের শূন্য রেখায় হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। এসব মানুষের জীবন বাঁচানো এখন খুবই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। তিনি আরও বলেন, এসমস্যা এখন আর বাংলাদেশ মিয়ানমারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটি এখন আন্তর্জাতিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই এসমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে।
দৈনিকদেশজনতা/ আই সি