এম. শরীফ হোসাইন, ভোলা :
ভোলা জেলায় ধান, গম, মাছ, হাঁস-মুরগি ও গবাদি পশু পালনের পাশাপাশি গত কয়েক বছর ধরে শুরু হয়েছে কাঁকড়ার চাষ। ইতোমধ্যে সাদা সোনা গলদা চিংড়ির বাজার দখল করতে বাণিজ্যিকভাবে জেলার দক্ষিণাঞ্চলের চরফ্যাশন উপজেলায় শুরু হয়েছে কাঁকড়া চাষ। কাঁকড়া চাষ করে সাবলম্বী হয়েছেন সেখানকার অনেক চাষী। কাঁকড়া চাষ, শিকার ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছে কয়েক হাজার মানুষ। এসকল কাঁকড়া রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন দেশেও রফতানি করা হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভোলার দক্ষিণাঞ্চলে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় চরফ্যাশন উপজেলার চর কচ্ছপিয়া, চর মন্তাজ, চর পাতিলা, চর দাঁতভাঙ্গা, কালকিনি, চর মানিকা, চর নিজাম, চর কুকরি-মুকরি, ঢালচরসহ মনপুরা উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নে প্রায় ৪০ হাজার হেক্টর ম্যানগ্রোভ বাগান বয়েছে। এসকল এলাকায় প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠেছে কয়েক শত ছোট-বড় খাল। এলাকাগুলো সাগরের কাছাকাছি হওয়ায় লবনাক্ত পানিতে এখানে প্রাকৃতিকভাবে প্রচুর পরিমাণে কাঁকড়া উৎপাদন হচ্ছে। এসকল খালে প্রতিনিয়ত ধরা পড়ছে বিপুল পরিমাণ কাঁকড়া। বড় আকারের কাঁকড়া খাল থেকে ধরে বিক্রি করা হলেও ছোট কাঁকড়াগুলো পুকুর বা হ্যাচারিতে চাষ করছেন অনেক চাষী।
কাঁকড়া চাষীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ এলাকাগুলো সাগর ও নদী প্রধান হওয়ায় খাল ও পুকুরে জাল দিয়ে হ্যাচারি তৈরি করে অনায়াসে কাঁকড়া চাষ করা হয়। লবনাক্ত পানির কারণে কাঁকড়া চাষে অনেক সুবিধা রয়েছে। তাছাড়া রোগ বালাইও কম হয়। কাঁকড়ার খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয় কুইচ্চা, কুচিলা, চেওয়া মাছ, চিংড়িগুড়া, শুঁটকি ও ওলুপা মাছ। কম খরচ ও কম পরিশ্রমে অধিক লাভ হওয়ায় চাষীরাও সারাদিন কাঁকড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকেন পুকুর ও হ্যাচারিতে।
চর কুকরি এলাকার কাঁকড়া চাষী ফিরোজ মেম্বার জানান, তিনি ২০১৩ সালে এফডিবি সংস্থার সহযোগিতায় প্রশিক্ষণ নিয়ে পুকুরে নেটজাল দিয়ে কাঁকড়া চাষ শুরু করেন। মাত্র কয়েক মাস পর তিনি কাঁকড়া বিক্রি করে পুঁজির চেয়ে কয়েকগুন টাকা আয় করেন। তখন থেকে তিনি কাঁকড়া চাষকে প্রধান পেশা হিসেবে নিয়েছেন। ফিরোজ মেম্বারের মতো একই এলাকার সবুজ, সাত্তার, বাবুল মুন্সি, সিরাজ হালাদারসহ শতাধিক চাষী কাঁকড়া চাষ কওে এখন তারা স্বাবলম্বী। তাদের দেখাদেখি অনেকে এখন এ পেশায় ঝুঁকে পড়ছে।
এদিকে, উপকূলে কাঁকড়া শিকার করে অনেক বেকার যুবক অর্থ উপার্জনের সুযোগ পেয়েছেন। এখানকার নদী ও খালগুলোতে কাঁকড়া শিকার করে অনেক পরিবার আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন।
একই এলাকার কাঁকড়া শিকারি ইয়াছিন বলেন, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন এ চার মাস অন্যান্য মাসের তুলনায় অনেক বেশি কাঁকড়া পাওয়া যায়। তখন দামও একটু কম থাকে। বর্তমানে কাঁকড়া কম পাওয়া গেলেও দাম অনেক বেশি। শিকারির সংখ্যাও বেড়েছে অনেক। প্রতিদিন যে কাঁকড়া পাই তা বিক্রি করে সংসার খুব ভালো চলে।
আরো জানা গেছে, চাষ ও শিকার করা কাঁকড়া বিক্রি করা হয় স্থানীয় আড়তে। ১০০ গ্রাম ওজনের নিচে প্রতি পিচ কাঁকড়া ২৫ থেকে ৩০ টাকা হারে প্রতি কেজি বিক্রি করা হয় ২শ’ ৫০ থেকে ৩শ’ টাকা। গ্রেড সাইজ হলো ২শ’ গ্রাম (গর্দা) এর ওপরে প্রতি কেজি ৫শ’ ৫০ টাকা, ৩শ’ গ্রাম ওজনের প্রতি কেজি ৭শ’ ৫০ টাকা, ৫শ’ গ্রাম ওজনের প্রতি কেজি ১ হাজার টাকা করে বিক্রি করা হয়। এসকল কাঁকড়া প্রতিদিন ঢাকায় চালান করা হয়।
চর কচ্ছপিয়া ঘাটের কাঁকড়া ব্যবসায়ী সিরাজ জানান, তার আড়তের অধীনে প্রায় শতাধিক কাঁকড়া শিকারি রয়েছে। চাষী ও শিকারিরা কাঁকড়া এনে তার আড়তে বিক্রি করেন। প্রতিদিন তিনি ঢাকা মোকামের সঙ্গে যোগাযোগ করে কাঁকড়া কেনেন। এসকল কাঁকড়া প্রতিদিন লঞ্চযোগে ঢাকা পাঠান। সেখান থেকে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বের ১৮ দেশে এ কাঁকড়া রফতানি করা হচ্ছে বলে তিনি জানান।
চরফ্যাশন উপজেলা মৎস্য সম্পদ কর্মকর্তা পলাশ হালদার বলেন, উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নে কাঁকড়া চাষ করে অনেক চাষী সফল হয়েছেন। কাঁকড়া চাষের উপর সরকারিভাবে প্রকল্প করা হচ্ছে। এ প্রকল্পে চাষীদের উন্নত প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহযোগিতা করা হবে বলে তিনি জানান।
এসকল চাষীদের উন্নত কারিগরি প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহযোগিতা করা হলে কাঁকড়া চাষে অনেকে আরও আগ্রহী হবেন বলে মনে করেন স্থানীয়রা। এতে প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রাসহ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন সচেতন মহল।
দৈনিক দেশজনতা /এন আর