নিজস্ব প্রতিবেদক:
ঘরের মধ্যে প্রায় কোমর পানি। বানের পানি কমার আশায় কেউ কেউ ভিটে-বাড়িতেই শত কষ্ট সয়ে বসবাস করছেন। কেউবা নিরুপায় হয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন রাস্তা কিংবা উঁচু কোনো জায়গায়। যখনই কোনো নৌকা চোখে পড়ে, বানভাসি মানুষেরা ত্রাণের আশায় পানির মধ্যেই ছুটে যান। নৌকাটি ত্রাণবাহী না হলে অসহায় মানুষগুলোর মুখ হয়ে পড়ে আরো মলিন। বন্যা কবলিত এলাকার মানুষের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে নারী ও শিশুরা। আর পরিবারের প্রবীণ ব্যক্তিটিও রয়েছেন একেবারেই অসহায় অবস্থায়।
উজান থেকে নেমে আসা পানির ঢলে নওগাঁর আত্রাই ও ছোট যমুনা নদীর বাঁধ ভেঙ্গে নওগাঁর সদর, মান্দা, রাণীনগর, আত্রাই, বদলগাছী, পত্নীতলা, মহাদেবপুর, ধামইরহাট সাপাহার ও পোরশা উপজেলার ৬৫টি ইউনিয়নের প্রায় তিন লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে দুর্গত এলাকা মান্দায় আছে প্রায় ১ লাখ মানুষ।
নওগাঁর মান্দা উপজেলার নুরুল্যাবাদ ইউনিয়নের পশ্চিম নুরুল্যাবাদ, উত্তর নুরুল্যাবাদ, জোতবাজার, কুশুম্বা ইউনিয়নের বড় বেলালদহ, ছোট বেলালদহ, শামুকখোল, প্রসাদপুর ইউনিয়নের বুড়িদহ, ঋষিপাড়া ও বিষ্ণপুর ইউনিয়ন হুলিয়াপাড়া, চকসল্লা, চক কামদেব, দাসপাড়া, পাড়ইটঙ্গি এলাকা ঘুরে এমন চিত্রই দেখা যায়।
নৌকা দেখলেই ছুটে আসছেন বানভাসিরা :
মান্দা উপজেলার বিষ্ণপুর ইউনিয়নে আত্রাই নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে গবাদি পশু সঙ্গে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে শতাধিক পরিবার। সেখানে নৌকা নিয়ে যেতেই ত্রাণের আশায় ছুটে আসেন অসংখ্য নারী-পুরুষ। ত্রাণের তালিকায় নিজেদের নাম যোগ করার অনুরোধও করেন তারা। সাংবাদিক পরিচয় পাবার পরই চুপসে যান তারা। মলিন হয়ে পড়ে মুখ। সাত দিন ধরে কোনো ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগ করেন বন্যার্তরা।
দাসপাড়া গ্রামের মাজেদা বেগম অভিযোগ করে বলেন, ‘হামরা দিনে এনে দিন খাওয়া মানুষ। হামার স্বামী ভ্যান চালায়। বন্যায় পথঘাট ডুবে যাওযায় সাত দিন ধরে ভ্যান চালাতে পারেনি। পোলাপান নিয়ে চিড়া-মুড়ি খ্যায়া আছি। ইলিপ দিবে বলে নাম লিখে নিয়ে গেছে কিছু লোক। কিন্তু এখন পর্যন্ত এক ছটাকও ইলিপ পাইনি। যেটুকু টাকা ছিল তাও শ্যাষ। ইলিপ না প্যালে মরা ছাড়া গতি নাই।’
বিষ্ণপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম জানান, তার ইউনিয়নের ৩০ হাজারের বেশি মানুষ বন্যাদুর্গত হয়েছে। এখন পর্যন্ত ত্রাণ বরাদ্দ এসেছে মাত্র ২ মেট্রিক টন। প্রশাসনের তরফ থেকে যেটুকু ত্রাণ পাওয়া যাচ্ছে লোকজন সেটুকুই পাচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, সড়ক পথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় বেসরকারিভাবে এখানে কেউ ত্রাণ দিতে আসছে না। ফলে অন্য এলাকার চেয়ে এখানকার লোকজন বেশি কষ্টে রয়েছে। নুরুল্যাবাদ ইউনিয়নের প্রসাদপুর-জোতবাজার রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছেন পাঁচ শতাধিক পরিবার। সেখানে আশ্রয় নেওয়া কিছু মানুষ ত্রাণ পেলেও অধিকাংশই ত্রাণ পাননি বলে জানা গেছে।
পশ্চিম নুরুল্যাবাদ গ্রামের ছায়েদা বানু বলেন, ‘হামার মতো কষ্টে কেউ নাই। ম্যানষের কাছত থ্যাকা চিড়া-মুড়ি চ্যায়া-ম্যাঙ্গা খ্যাচ্ছি। এখনও কেউ অ্যানা ইলিপ দিল না। স্বামী নাই। জোয়ান বেটাও নাই। হামি বেটিছাওয়াল মানুষ ইলিপ চাইতে কার কাছে যামু।’ উত্তর নুরুল্যাবাদ গ্রামের নাজমুন নাহার গত সাত দিন ধরে ছয় মাসের শিশু সন্তান নিয়ে রয়েছেন রাস্তায়।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাচ্চাটা কয়দিন ধরে ঠিক মতো বুকের দুধ পাচ্ছে না। দোকান থেকে সুজি কিনে এনে খাওয়াচ্ছি। বাচ্চা খিদায় কান্নাকাটি শুরু করলে কষ্টে আমার বুকটা ফেটে যায়। মা হয়ে আমি কিছুই করতে পারি না।’
নুরুল্যাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মন্ডল বলেন, ‘যেটুকু ত্রাণ পাওয়া গেছে তা খুবই সামান্য। আমার এলাকায় দেড় হাজার পরিবারের তালিকা করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত বরাদ্দ এসেছে ২ মেট্রিক টন। তিন ভাগের এক ভাগ পরিবারকেও ত্রাণ দিতে পারিনি।’
মান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নুরুজ্জামান বলেন, ‘দুর্গত মানুষদের মাঝে এখন পর্যন্ত ৪৭ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ১ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। যারা আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন তাদেরকে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। তবে অনেকে যারা বিভিন্ন রাস্তার ওপর কিংবা পানির মধ্যে কষ্টে করে বাসা-বাড়িতে রয়ে গেছে। তারা হয়তো কেউ কেউ তালিকা থেকে বাদ পড়ার কারণে ত্রাণ পাচ্ছেন না।’
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আব্দুল মান্নান জানান, জেলায় বন্যার্তদের ত্রাণ সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে। এ পর্যন্ত জেলায় ৩৪৭ মেট্রিক টন চাল এবং ১৫ লক্ষ ২২ হাজার নগদ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে আত্রাই উপজেলায় ২৭ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ২ লাখ ৯০ হাজার টাকা, ধামইরটহাট উপজেলায় ৪৬ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ১ লাখ টাকা, মান্দা উপজেলায় ৭১ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা, নওগাঁ সদর উপজেলায় ২৫ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা, রানীনগর উপজেলায় ২৮ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ২ লাখ ১২ হাজার টাকা, সাপাহার উপজেলায় ২৫ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা, মহাদেবপুর উপজেলায় ৩০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ৬৫ হাজার টাকা, পত্নীতলা উপজেলায় ৬৫ মেট্রিক টন চালও নগদ ২ লাখ টাকা, বদলগাছি উপজেলায় ২৫ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং পোরশা উপজেলায় ৫ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ৫০ হাজার টাকা।
নওগাঁর জেলা প্রশাসক ড. মো. আমিনুর রহমান জানান, ‘ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চলছে। তবে অনেক এলাকায় সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে কিছুটা ভাটা পড়েছে। তবে পর্যায়ক্রমে সব কিছু কাভার করা হবে।
নওগাঁ জেলার মোট ১০টি উপজেলায় ৬৬টি ইউনিয়নের ৫১৬টি গ্রাম বন্যা কবলিত হয়েছে। জেলার ৩ লাখ ৬২ হাজার ৯৫জন মানুষ পানিবন্দি হয়ে জীবনযাপন করছেন। এখন পর্যন্ত জেলার ৪১টি আশ্রয় কেন্দ্রে প্রায় ৫ হাজার মানুষ বসবাস করছেন। বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে ১২৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। জেলায় মোট ৬৮ হাজার হেক্টর জমির ফসল বিনষ্ট হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে জেলার প্রায় ৮১ হাজার বাড়ি ঘর। এর মধ্যে ৫৫ হাজার বাড়িঘর সম্পূর্ণভাবে এবং ২৬ হাজার বাড়িঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ