নিজস্ব প্রতিবেদক:
কেউ কেউ খুচরা বিক্রির উদ্দেশ্যে নৌকা চালিয়ে যাচ্ছে অদূরে। কেউবা করছে পেয়ারা রফতানির বন্দোবস্ত। কেউ দিচ্ছে নৌকার জোগান। তার মাঝে পেয়ারা নিয়ে আসা চাষিরা মলিন মুখে এক পাইকার থেকে নৌকা ভিড়াচ্ছে অন্য পাইকারের কাছে। দুটি টাকা বেশি পাবে এই আশায়।
নিরুপায় চাষীদের এমন দৃশ্য দেখা গেছে ঝালকাঠি জেলায় অবস্থিত বিখ্যাত পেয়ারার ভাসমান বাজার ভিমরুলি’তে। এখানে বাজার শুরু হয় বেলা ১১টার দিকে। আর বাজারের রসদ জোগাতে পেয়ারা চাষিদের কর্মযজ্ঞ শুরু হয় ভোর ৪টা থেকে। সূর্যের আলো ফোটার আগেই নাও কোন্দা (তালগাছের নৌকা) নিয়ে বাগানে হাজির হন পেয়ারা তুলোনিরা (শ্রমিক)।
সকাল ৯টা থেকে ১০টা পর্যন্ত চলে পেয়ারা তোলার কাজ। আর এতেই প্রতি পারুনিকে দিতে হয় দিনে ৩৫০-৪০০ টাকা বেতন। এরপর নৌকায় করে চাষী তা নিয়ে যান পেয়ারার ভাসমান হাটে। তবে বাজারে গেলেই মুখগুলো মলিন হয়ে যায় প্রত্যেক চাষীর। হাটে পেয়ারার যে দাম চাষীরা পান, তাতে শ্রমিকের মজুরিসহ বাজার খরচ ওঠে না। তবে যাদের নিজস্ব বা পরিবারের শ্রম দেবার সামর্থ্য আছে তারা কিছুটা লাভের মুখ দেখেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, বরিশালসহ এই বাজারের আশপাশের জেলাগুলোতে পেয়ারা খুচরা বিক্রি হচ্ছে ২০-২৫ টাকা কেজি দরে। আর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই পেয়ারার খুচরা মূল্য চলছে ৩০-৪০ টাকা পর্যন্ত। চাষির হাত থেকে এসব পেয়ারা স্থানীয় আড়তদার বা মধ্যসত্ত্বভোগী হয়ে চলে যায় দূর থেকে আসা পাইকারদের হাতে। এই প্রক্রিয়ায় কেজিতে ৮-১০ টাকা ঢুকছে মধ্যসত্ত্বভোগীর পকেটে।
বাজার ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ পেয়ারা বিক্রি হচ্ছে মণপ্রতি ১৮০-২০০ টাকা পর্যন্ত। একটু বেশি পাকা পেয়ারা বিক্রি হচ্ছে মণপ্রতি ১২০-১৪০ টাকা পর্যন্ত। তবে পুরোপুরি কাঁচা পেয়ারা এখানে বিক্রি হচ্ছে মণপ্রতি ৩০০-৩২০ টাকায়। অর্থাৎ এখানে কেজিপ্রতি ৩-৪ টাকা থেকে শুরু করে ৫ টাকা পর্যন্ত পাইকারি বিক্রি হচ্ছে পেয়ারা।
চাঁদপুর এবং চট্টগ্রামের পাইকারদের কাছে কাঁচা পেয়ারার চাহিদা একটু বেশিই বলে জানালেন স্থানীয় চাষীরা। জানা যায়, ঝালকাঠি-পিরোজপুর-বরিশালের এই সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রায় ২০ হাজার মানুষ পেয়ারা চাষের সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে আটঘড়, কুরিয়ানা, জলাবাড়ী, স্বরূপকাঠি, আদমকাঠি ইত্যাদি গ্রামের প্রায় ১৪০০ পরিবারের প্রধান জীবিকা পেয়ারা চাষ।
স্থানীয় একটি পেয়ারা বাগানের মালিক গোপাল বলেন, পেয়ারা আমাদের স্বপ্নের ফসল। আমাদের স্বপ্ন-সাধনার সঙ্গে মিশে আছে পেয়ারা। তবে নানা প্রতিবন্ধকতায় পেয়ারা ব্যবসায় আসছে ধস। এর ফলে পেয়ারার বদলে বৃদ্ধি পাচ্ছে আম্রার চাষ।
পেয়ারা চাষী সুবোধ শিকদার (৫৫) বলেন, ‘কি আর কমু? বেইন্না বেলায় ৩ জন মানু লইয়া গইয়া তুইলা হাডে আইয়া ২২০ টাহা দর বেচলাম। খরচা দিয়া আর কিকছুই রইলে না।’ বরগুনা থেকে ট্রলার নিয়ে আসা পাইকারি ব্যবসায়ী ফরিদ বলেন, আমাদের খুব বেশি ব্যবসা হয় না। কারণ পরিবহন খরচ রয়েছে। আর সময়মতো বাজার ধরতে না পারলে যেতে যেতে অনেক পেয়ারা পচে যায়। এসব কারণে খুব বেশি দাম দিয়ে কেনা সম্ভব না।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় আড়তদার রহিম মিয়া বলেন, ‘পাইকার এলে তাদের পেছনে খরচ আছে। বাকিতেও দিতে হয় অনেক সময়। আবার বাকিতে দেয়া সব টাকা আমরা পাই না। তাই চাষীদের থেকেই একটু কমিয়ে কিনতে হয়।’
পেয়ারা চাষীরা জানালেন, পচনশীল এই পণ্যটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এই অঞ্চলে নেই কোনো ব্যবস্থা। সরকার যদি এই অঞ্চলের পেয়ারা প্রক্রিয়াজাতকরণ করার ব্যবস্থা করতে পারে তবে হাসি ফুটবে হাজারো পেয়ারা চাষীর মুখে।
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ