নিজস্ব প্রতিবেদক:
তামা পিতলে শুধুই বাসন-কোসনই নয়, এই তামা পিতলে তৈরি হতে পারে নিঁখুত সব ভাস্কর্য। তারই জ্যান্ত প্রমাণ ঢাকা থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার উত্তরে ধাইরাইয়ে। আমাদের দেশের মানুষদের মাঝে এই তামা শিল্পের পুরো কার্যক্রম খুব বেশি আলোচিত না হলেও প্রতিবছর ধামরাইয়ের এই তামা পল্লী ঘুড়ে যায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ভাস্কর্য প্রেমীরা। এখানে তামার ভাস্কর্য নির্মানের ইতিহাসটা পাল রাজত্বের পরে ১২ শতকের দিকে এই শিল্প হারিয়ে যেতে থাকে।
পরবর্তীতে আবার ৭০ দশকে মোশারফ হোসন ও সাক্ষী গোপাল বনিক মিলে আবারো তামা-পিতলে ভাস্কর্য তৈরি শুরু করেন। যা এখনো চলছে। ধামরাইয়ের এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে বর্তমানে কাজ করছেন সুকান্ত বনিক। তার নিরলস শ্রম আর মেধার বদৌলতেই ধামরাইয়ে এখনো টিকে আছে এই তামা শিল্প।
বর্তমান ও ভবিষ্যৎ :
তামার ভাস্কর্য তৈরি করতে সুকান্ত বনিক কাজ করেন পাল সম্প্রদায়ের কিছু কারিগরকে নিয়ে। এখানে প্রায় ২২ জন কর্মীকে নিয়ে এই মুর্তি গড়ার কাজগুলো করে থাকেন সুকান্ত। তামার তৈরি নিঁখুত নারী মুর্তি, দাবার ছক, হাতির পিঠে রাজা এমন সব দুর্লভ ও নান্দনিক ভাস্কর্য তৈরি করেছেন সুকান্ত।
এসব ভাস্কর্য তৈরি পদ্ধতিও অবাক করার মতো। মোম দিয়ে তৈরি পদ্ধতি অবলম্বন করেই এসব ভাস্কর্য তৈরি করা হয়। যে বিশেষ ভাস্কর্যটি তৈরি করা হবে তার একটা অবয়ব তৈরি করা হয় মোম দিয়ে। এরপর তাতে নানান নকশা ও সুক্ষ কারুকাজগুলো ফুটিয়ে তোলা হয়। এরপর মোমের সেই মূর্তির উপরে চড়িয়ে দেয়া হয় তিন স্তরের মাটির প্রলেপ। এরপর তা পোড়ানো হয়। ফলে ভেতর থেকে মোমের মূর্তিটি গলে বেরিয়ে আসে। থেকে যায় শুধু মাটির ছাচে মোমের মুর্তির প্রতিবিম্ব। এরপর সেই মাটির ছাচে গলে যাওয়া তামা ঢুকিয়ে তৈরি করা হয় এই ভাস্কর্যগুলো। যেকোনো অবয়ব ফুটিয়ে তোলা সম্ভব এই ভাস্কর্যগুলোতে।
বর্তমানে এই ভাস্কর্যগুলোর প্রধান ক্রেতা হলো বিদেশি ভাস্কর্য ব্যবসায়ীরা। মাত্র ৮শ ডলারে কেনা মুর্তিগুলোকে বিদেশীরা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ৫ হাজার ডলার পর্যন্ত দাম চড়িয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করছে। অথচ আমাদের দেশে এর তেমন কোনো প্রচারই নেই। ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই শিল্পের চাহিদা আছে ব্যাপক। অথচ শুধুমাত্র প্রচারের অভাবে এই শিল্প এখনো পড়ে আছে ধামরাইয়ের এক নিভৃত কোনে।
এই ধরনের তামা-পিতলের ভাস্কর্য বানানোর প্রয়াস আমাদের দেশে ধামরাই ছাড়া আর কোথাও নেই। যদিও ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়ায় এ ধরনের কিছু শিল্প তৈরির প্রয়াস থাকলেও তা কেবল নান্দনিক বাসন-কোসনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এতো বড় একটা শিল্পক্ষেত্র যা কিনা আমাদের দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের এক প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে। অথচ তা পুরোপুরি অবহেলিত।
সুকান্ত বনিকের মতো এমন অনেক পাল বংশিয় আছেন যারা এখনো স্বপ্ন দেখেন, একদিন বাংলাদেশে তামা পিতলের ভাস্কর্য তৈরির আলাদা অবস্থান তৈরি হবে। এরজন্য প্রয়োজন শুধুই সরকারী পৃষ্ঠপোশকতা আর শিল্পের পরিচিতি।
এককালে কাঁসা শিল্পের ব্যাপক প্রসার ও রমরমা অবস্থা থাকলেও বর্তমানে চলছে চরম দুর্দিন। নানা প্রতিকূলতার কারণে এই কাঁসা শিল্পে নিয়োজিত প্রায় ৭৮ হাজার শ্রমিকের ভবিষ্যৎ এখন অনেকটাই অনিশ্চিত। এরই মধ্যে বহু শ্রমিক পেটের দায়ে অন্য পেশায় চলে গেছে। আবার অনেকে জীবিকার অন্বেষণে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে চলে গেছে।
রাজা গৌড় গোবিন্দের শাসনামলে ভারতের কংশ বণিকদের মাধ্যমে বাংলাদেশে কাঁসা শিল্পের আবির্ভাব ঘটে। কংশ বণিকরাই এ শিল্পের স্রষ্টা। হিন্দুদের বিয়েশাদি এবং পূজা-পার্বণে কাঁসার ব্যবহারকে পূত-পবিত্র বলে বিশ্বাস করা হয়ে থাকে।
বর্তমানে ঢাকার জিনজিরা, ধামরাই, মানিকগঞ্জ, নরসিংদী এবং বিক্রমপুরে কাঁসা শিল্প কোনোমতে টিকে আছে। এ শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকরা এখনও প্রাণ দিয়ে এই শিল্পকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। জিনজিরা ও ধামরাইয়ের কাঁসা শিল্পে নিয়োজিতরা জানান, এককালে কাঁসা শিল্পের চাহিদা ছিল, মানমর্যাদা ছিল শিল্পীদের। ভাগ্যের দুর্বিপাকে এ পেশায়ও নেমে এসেছে দুর্দিন। আধুনিকতার চরম উৎকর্ষে মনোরম চোখ ধাঁধানো আকর্ষণীয় সিল্টলের সামগ্রী, মেলামাইন ও দেশ-বিদেশের নজর কাড়া কাচের রকমারি সামগ্রীর কারণে মান্ধাতার আমলের কাঁসা শিল্প চরমভাবে মার খাচ্ছে।
এছাড়া অন্যান্য সামগ্রীর তুলনায় কাঁসার মূল্য তুলনামূলকভাবে বেশি। এ কারণেও ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। অন্যদিকে কাঁচামালের মূল্যও অত্যন্ত চড়া। ফলে আগের মতো আর পুষিয়ে উঠতে পারছেননা কাঁসারুরা। কোনোমতে টানাপোড়নের মধ্যদিয়ে চলছে তাদের সংসার।
শত প্রতিবন্ধকতা আর চরম হতাশার মধ্যেও কাঁসা শিল্পীরা সযত্নে কাঁসা দিয়ে কলস, বাটি, বালতি, পানদানি, প্রদীপ, চিলোমচি, ফুলের টব, গামলা, তবলা, ডিশ, থালা-বাসন, মূর্তি ও দাঁড়িপাল্লাসহ সৌন্দর্যবর্ধক নানা সামগ্রী তৈরি করে তা বাজারজাত করছেন।
এই শিল্পকে ভর করে এখনো দেশের হাজার হাজার কাঁসা শিল্পী বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। কাঁসা শিল্পীরা জানান, তারা ঢাকার বকশীবাজার থেকে ২০০-২২০ টাকা কেজি দরে কাঁচামাল কিনে নানা সামগ্রী তৈরি করে তা বিক্রি করেন মাত্র ২৭০ টাকায়। তবে পাইকাররা তাদের কাছ থেকে কম দামে কিনলেও বেশি দামে তা বিক্রি করেন।
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ