দৈনিক দেশজনতা ডেস্ক:
যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী বাংলাদেশি বংশোদ্ভুতরা, ঢাকার দলীয় রাজনীতি করেন এখানে এটা অনেক পুরোনো খবর। সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতি চর্চা প্রবাসে না করে বরং এখানকার মূলধারায় নিজেদের সম্পৃক্ত করতে বেশি বেশি স্থানীয় আমেরিকান রাজনীতিতে প্রবেশের চাপ এবং অনুভব আছে সমান ধারায়। এরই ধারাবাহিকতায় এখানে কয়েকটি বড় বড় শহরে বাংলাদেশিরা রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হচ্ছেন।
একেবারে তৃণমূল থেকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেওয়ার পথে এর মধ্যে বেশ কয়েকটি শহরের সিটি কাউন্সিলে সদস্য পদে জয়ী হয়েছেন বাংলাদেশিরা। নিউইয়র্কের পাশের রাজ্য নিউজার্সির প্যাটারসন তার-ই একটি। কিন্তু এখানে বাংলাদেশি অভিবাসীদের সিটি কাউন্সিল জয়ের সংবাদের বাইরে সবচে আলোচিত বিষয় হলো, এক আসনে দুই বাংলাদেশির কোটি টাকার লড়াই। যেটা এখানকার স্থানীয় সব সংবাদে এমনকি ইউএসএ টুডের মতো শীর্ষস্থানীয় পত্রিকায় শিরোনামও হয়েছে। তার কারণ, এখানে সিটি কাউন্সিল আসনের যে খাজনা তার চেয়ে বেশি বাজনার সূত্রপাত হয়েছে একটি কাউন্টির দুই প্রতিদ্বন্দ্বীকে কেন্দ্র করে। প্যাটারসনের প্যাসিক কাউন্টির কাউন্সিলর পদে ২০১৬ সালে জয়ী হয়েছেন, এখানকার পরিচিত মুখ, ব্যবসায়ী শাহিন খালিক। কিন্তু ওই নির্বাচনে পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে যারা শাহিনের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন, সেগুলোতে অনিয়মের প্রাথমিক অভিযোগ তোলেন তারই প্রতিদ্বন্দ্বী, ওই কাউন্টির আগের বারের নির্বাচিত কাউন্সিলম্যান মোহাম্মদ আখাতারুজ্জামান। ফলে ২০১৬ সালে নির্বাচনে জয়ের পর প্রথম দফায় আখতারুজ্জামান নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে মামলা ঠুকে দেন অনিয়মের অভিযোগে। সে সময় নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল একাধিক বার গণনা করার পর, বরং শাহিন খালিকের বাক্সে আগের প্রদত্ত ভোটের বাইরে আরো একটি অতিরিক্ত ভোট খুঁজে পান। সে সময় নির্বাচনে জয়ী কাউন্সিলম্যানরা আনুষ্ঠানিকভাবে নগর পরিচালনার শপথ নেন, তার মধ্যে শাহিন খালিকও ছিলেন। তিনি সিটি কাউন্সিলের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ভোটে অনিয়মেন অভিযোগ থেকে সরে আসেননি পরাজিত কাউন্সিলম্যান আখতারুজ্জামান। তিনি ওই মামলা নিয়ে যান আদালতে, পুনরায় নির্বাচনের জন্য। দীর্ঘ এক বছরের বেশি সময় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে প্রদত্ত ভোটের মধ্য থেকে অসঙ্গতি এবং শতভাগ নিশ্চিত না হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ২২টি ভোট বাতিল করেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে দু’জনের যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই, সেখানে শাহিন খালিক এগিয়ে থাকেন ৩টি ভোটে। আদালত তার পক্ষেই রায় দিয়ে ২ সপ্তাহ আগে ৩০ জুলাই। সেখানেই থেমে যেতে পারতো এ দুই বাংলাদেশির ভোটযুদ্ধ, তবে তা মনে হয় থামছে না। কারণ আদালতের রায় মেনে নিলেও এক বাক্যে আকতারুজ্জামান বলছেন, কিছু একটা ঝামেলা আছে। আদালত নিজেই স্বীকার করেছেন যে ভুয়া ভোট ছিল ২২টি। এর পরও রায়ে নির্বাচন বাতিল না করে শাহিন খালিকের পক্ষে রায় দেওয়াটা তিনি মানতে পারছেন না। প্রয়োজনে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন এ প্রতিবেদকের কাছে। অন্যদিকে নির্বাচিত কাউন্সিলর শাহিন খালিক জানিয়েছেন, তিনি ভাবছেন যদি এ রায় নিয়ে আবার কোনো আইনি জটিলতায় যান আখতারুজ্জামান, তাহলে তিনি তার আইনি লড়াই চালানোর দেড় লাখ ডলার বা প্রায় দেড় কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে উল্টো মামলা করবেন আখতারুজ্জামানের বিরুদ্ধে।
সব মিলিয়ে এ দুই বাংলাদেশির আইনি লড়াই এখন বেশ আলোচিত খবর প্যাটারসনের রাজনীতিতে, কেননা এক নির্বাচনের ফলাফল নিজেদের আয়ত্তে নিতে আখতারুজ্জামান আইনজীবীদের পেছনে খরচ করেছেন ১ লাখ ডলার। আর শাহিন খালিক খরচ করেছেন ১ লাখ ৫০ হাজার ডলার। তার আগে মূল নির্বাচনের সময় অভিযোগ আছে দুই প্রার্থী প্রায় হাফ মিলিয়ন ডলার করে খরচ করেছেন নিজেদের পক্ষে ভোট রাখতে। কিন্তু যে শহরের সিটি কাউন্সিল পরিষদের একজন কাউন্সিলর হওয়ার জন্য এ যে খরচ তারা আগে করেছেন, এখনো করে যাচ্ছেন, সেই সিটি করপোরেশনের মোট বার্ষিক কর্মচারী ব্যয় (সব কাউন্সিলর-মেয়র এর বেতন) মাত্র ৪১ হাজার ডলার। এ কারণেই অভিবাসীদের কেউ কেউ বলছেন, শহরের যত খাজনা, তার চেয়ে বেশি বাজিয়ে চলেছেন বাংলাদেশের দুই রাজনীতিক, যারা মূল ধারায় নিজেদের নাম লেখাতে গিয়ে জড়িয়ে পড়েছেন এক মল্লযুদ্ধে। জানতে চাইলে শাহিন খালিক বলেন, ‘দেখুন আমি আর কি বলব, আগেই বলেছি, আমার প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশের রাজনীতি এখানে চর্চা করতে চাইছেন। নির্বাচন হয়, জনগণ তার পছন্দের প্রার্থীকেই ভোট দিয়েছে, এটা তিনি মেনে নিতে না পেরে টাকার খেলায় নেমেছেন। আমি আমার আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলছি এবং উনি যদি এ আদালতের রায় না মেনে নিয়ে, আবার আমাকে আইনি ঝামেলায় নিতে চান আমি তার বিরুদ্ধে আমার যাবতীয় আইনি খরচ ফেরত দেওয়ার মামলা করবে। কেননা এ আইনি যুদ্ধে যাবার আগে তিনি বন্ড দিয়ে স্বাক্ষর করেছিলেন, যে মামলায় হেরে গেলে আমাকে ক্ষতিপূরণ দেবেন।’ অন্যদিকে মোহাম্মদ আখতারুজ্জামানের সঙ্গে এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দেখুন আদালত বলেছেন যে ২২টি ভোট ভুয়া। তার অর্থ আমি যে অভিযোগ দিয়েছিলাম সেটা সত্য। এখন আমি জানি না কি করে আদালত তাকে জয়ী ঘোষণা করলে। আমি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তবে আমার ওপর চাপ আছে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করার জন্য। আমি ভাবছি কি করা যায়, সব অপশন খোলা আছে।’ তেমন যদি হয় তাহলে আবারো একটি টাকার খেলা বাকি আছে। কেননা, এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে গেলে আখতারুজ্জামানকে আরো গুণতে হবে প্রায় ৭০ হাজার ডলার। সেই টাকা যোগাড় করা তার জন্য অসম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে আগের আইনি খরচ দেড় লাখ ডলার ফেরত দেওয়ার জন্য মামলার চিন্তা ভাবনা করছেন শাহিন খালিক। সে কারণে এক পড়ন্ত সিটির একটি কাউন্সিলর পদে টিকে থাকার জন্য দুই বাংলাদেশি অভিবাসীর যে দ্বন্দ্ব আর যুদ্ধ তা এখন নিউজার্সিতে অন্যতম আলোচিত বিষয়। আর যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশিদের কাছে তো বটেই। এ কারণে আরো আলোচিত বিষয়টি কেননা, তারা দু’জনই অভিবাসী, দু’জনেই বাংলাদেশের সিলেট থেকে আগত।
দৈনিকদেশজনতা/এন এইচ