নিজস্ব প্রতিবেদক:
দৈন্যতা তাদের পিছু ছাড়েনা, প্রতিকূলতা তাদের চেপে ধরে প্রতিনিয়ত। তারা মাছ ধরতে যায় দূর সমুদ্রে হাজারো প্রতিকূলতার মাঝে। দেশ যখন আমাদের ইলিশ বা বাংলাদেশের ইলিশ বলে উৎসব পালন করছে তখন জেলারা বলেছে ইলিশ বাংলাদেশের না। তারা এ কথা বলছেন শত ক্ষোভ আর হতাশা নিয়েই। মিয়ানমার আর ভারতের কাছ থেকে সমুদ্র বিজয়ের পরেও বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সমুদ্র সীমায় বিদেশি জেলেরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তেমন কার্যকরী পদক্ষেপ নেই জেলেদের নিরাপত্তায়। এরিমধ্যে নতুন করে ইলিশের জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন (জিআই) বা ভৌগলিক নির্দেশকের খুশির খবরটি যেন জেলে পল্লীগুলোতে লেশমাত্র আনন্দ যোগ করেনি।
বরগুনা জেলার অনেক জেলেদের সাথে কথা বলে মিলেছে অনেক রকমের তথ্য। উঠে এসেছে বিদেশি ট্রলার আতঙ্কের কথা, প্রযুক্তির অপর্যাপ্ততার কথা। জেলেরা বলছে এখনো তারা ভারতীয় ট্রলার আতঙ্কে দিশেহারা। বঙ্গোপসাগর থেকে প্রতিদিন ভারতের জেলেরা ধরে নিয়ে যাচ্ছে রুপালি ইলিশসহ বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ। পাশাপাশি বাংলাদেশের জেলেদের ট্রলার লুট করছে। অনেক জেলেরা বলছেন, ভারতীয় জেলেরা বাংলাদেশের জলসীমায় তাদের ফিশিং করতে দিচ্ছে না।
বরগুনা সদর উপজেলার ৭নং পোটকাখালি গ্রামের জেলে মানিক মিয়া বলেন, ‘কিছুদিন আগে বাংলাদেশ সমুদ্র বিজয় করে অনেক মাতামাতি করলো। ভাবছিলাম এইবার বুঝি শান্তিতে মাছ ধরতে পারুম। কিন্তু কাজ হইলো না কোনো আইনেই। সেই ভারতীয় ট্রলার ঠিকই আমাগো সীমানার ভেতরে মাছ ধরে। তাদের কিছুই কওয়াও যায়না। তারা আমাদের উপকূল দাপিয়ে বেড়ায়, কোনো কোনো সময় বঙ্গোপসাগরের কুল ঘেঁষে মাছ ধরে নিয়ে যায়। আর তাদের কিছু বলতে গেলে আমাদের উপর আক্রমণ চালায়।’ কেওড়াবুনিয়া গ্রামের জেলে সাইদ বলেন, ‘ভারতীয় ট্রলারগুলো এক সাথে অনেকগুলো থাকে। আর আমদের ক্ষেত্রে তেমনটি হয়না। তাছাড়া ভারতীয় সব বোটে ওয়ারলেস থাকে। ফলে তারা চাইলেই অনেক বোট এক হতে পারে। আর বাংলাদেশের জেলেদের বোটে ওয়ারলেছ না থাকায় এক হতে পারেনা। আমরা তাদের নির্যাতনের শিকার হই, নিরুপায় হয়ে মেনেও নিতে হয়।’
বরগুনা সদর উপজেলার বড়ইতলা গ্রামের জেলে ফারুক খান বলেন, ‘বিদেশি ট্রলার এখনো আমাদের জন্যে আতঙ্ক। দেখলেই ভয় লাগে। সাগরে তাদের ভয়ে আমরা মাছ ধরতে পারিনা। অনেক সময় তারা মহিপুর পর্যন্ত চলে আসে। আমরা কি বলবো? আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীও তো তাদের ধরেনা। কিন্তু আমরা যদি ঝড়ের কবলে পরে অন্য জলসীমায় কখনো ভুলেও ঢুকে পরি আমাদের আটকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেয়।’ তবে সদ্য ঘোষিত জিআই এর খবরটি এখনো পৌঁছায়নি প্রান্তিক জেলেদের মাঝে। সরাসরি একাধিক জেলের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ইলিশের ভরা মৌসুমে জেলেরা ইলিশ নিয়েই ব্যস্ত রয়েছেন। তাদের এখনো জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন (জিআই) কি বা কেন এই ব্যাপারে জানার তেমন কোনো আগ্রহ নেই। কেউ কেউ বলছেন তাদের এসব রাষ্ট্রীয় ইস্যুতে আগ্রহ নেই। জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন (জিআই) এর মাধ্যমে ইলিশের স্বত্ব লাভ করেছে বাংলাদেশ এমন খবর কি শুনেছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তালতলির হরিনবাড়িয়া এলাকার রুস্তম মাঝি বলেন, ‘এহনো হুনি নাই তয় আমার যতদূর মনে হয় সরকার আবার নতুন কোনো চিন্তা-ভাবনা করতে আছে মোগো লইয়া।’
জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন (জিআই) এর মাধ্যমে ঘোষণা করা হয়েছে ইলিশ বাংলাদেশের বা আপনাদের নিজস্ব পণ্য, এমন ঘোষণার পর একজন জেলে হিসেবে আপনার কেমন লাগছে? এমন প্রশ্নের জবাবে বরগুনা বড়ইতলা ফেরিঘাট এলাকার জেলে হামিদ হাওলাদার বলেন, ‘ভালো লাগছে তয় আমাগো পণ্য হইলো কেমনে? ভারতীয় আর মায়ানমারের ট্রলারে দেহি মাছ ধরে। আমাগো চাইতো হেরাওতো কম ধরেনা।’ জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন (জিআই) নামক একটি ঘোষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ১০০ ভাগের ৬৫ ভাগ ইলিশের মালিক , খবরটি আপনার কাছে কেমন লাগছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে বরগুনা পাথরঘাটার জেলে রফিক বলেন, ‘ভাই এই খবরে আমাগো লাভ-ক্ষতি কি? জাটকা ধরা বন্ধ রাইখা একই বোটের ৮ জনের মধ্যে চাউল পায়ছে ৩ জনে। ৩ জনের চাউল ৮ জনে ভাগ কইরা নিছি। তহন কেমনে সংসার লইয়া চলছি কইতে পারেন? এইসব হিসাব দিয়া আমাগো লাভ-ক্ষতি নাই। মাছ পাইলে পেট চলে, না পাইলেতো……।’
দৈনিকদেশজনতা/ আই সি