এম. শরীফ হোসাইন, ভোলা :
গত কয়েক দিন ধরে সাগরে জেলেদের জালে ইলিশের দেখা মিললেও ভোলার মেঘনা-তেঁতুলিয়ায় ইলিশের দেখা নেই। কারণ হিসেবে ডুবচরকে দায়ী করেছেন জেলে ও ইলিশ বিশেষজ্ঞরা। অথচ এখন ইলিশের ভরা মৌসূম। গত কয়েক বছর আগেও এ সময়ে মেঘনা-তেঁতুলিয়া জেলেদের জালে ঝাঁকে ঝাঁকে রূপালী ইলিশ দেখা যেতো। ভরা মৌসূমে ইলিশ না পেয়ে চরম হতাশায় দিন কাটাচ্ছে ভোলার উপকূলের জেলেরা।
জেলেরা জানান, জ্যৈষ্ঠ মাসের শুরু থেকে কার্তিকের শেষ পর্যন্ত ইলিশ ধরার মৌসূম। এর মধ্যে আষাঢ়-শ্রাবণ ইলিশের ভরা মৌসূম। সে অনুযায়ী এখন জালে ঝাঁেক ঝাঁকে ইলিশ পড়ার কথা। কিন্তু তা পড়ছে না। অথচ এনজিওর ঋণ ও মহাজনদের দাদনের টাকার চাপে দিশেহারা হয়ে পরেছেন জেলেরা।
ভোলার দৌলতখান উপজেলার মেদুয়া ইউনিয়নের বাঁধের পাড়ে থাকেন মোঃ হানিফ (৩৪)। মেঘনা নদীতে মাছ ধরে সংসার চলে তাঁর। ইলিশের আকালে অচল হওয়ার পথে তাঁর পাঁচ সদস্যের সংসার।
তিনি আরও বলেন, ভোরে ফজরের আজানের আগে ৪/৫ জন জেলে মিলে তাঁরা নদীতে জাল ফেলেন। জাল তোলার পর মাত্র দুটি ইলিশ দেখা পায়। বিক্রি করে পাওয়া গেছে ২শ’ ৫০ টাকা। তাও আবার চার ভাগ হয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হানিফের মতো অনেক জেলে মেঘনায় ইলিশ না পেয়ে বেকার বসে আছেন। তাঁরা জানান, ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে গেলে তাঁদের জ্বালানি তেল ও খাবার খরচই উঠতে চায় না। এ জন্য মাছ ধরতে না গিয়ে বসে আছেন।
মেদুয়া মাঝির হাটের মোঃ ফারুক মাঝি (৩২) বলেন, মৌসূমের শুরুতে অনেক আশা নিয়ে তিনি জাল নিয়ে নদীতে যান। মাছ না পেয়ে শেষে তাঁকে শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছে। বারবার একই ঘটনা ঘটায় এখন ইলিশ ধরতে যাওয়ার উৎসাহও কমে গেছে। জ্বালানি তেলসহ আনুষাঙ্গিক খরচ বেড়ে যাওয়াও তাঁদের মাছ ধরতে না যাওয়ার একটি বড় কারণ।
দৌলতখানের মদনপুরের জেলে সিরাজ মাঝি (৪৫), নাছির মাঝি (৩৫), নুরুল ইসলাম মাঝিসহ (৪৯) অনেক জেলে বলেন, ট্রলার নিয়ে মাছ ধরতে গেলে দুই-তিন হাজার টাকা খরচ হয়। প্রথম দিকে প্রতিবারে দুই-এক হালি করে ইলিশ পাওয়া গেলেও এখন মাছ পাওয়াই দায়। এতে খরচ উঠে না। তাই তাঁরা উৎসাহ পাচ্ছেন না।
ভরা মৌসূমেও মাছ না পড়ার কারণ হিসেবে সদর উপজেলার তুলাতুলির জেলে আ. মতিন মাঝি (৬১) জানান, ইলিশের উৎস হিসেবে পরিচিত ছিল মেঘনার শাহবাজপুর চ্যানেল। ঝাঁকে-ঝাঁকে ইলিশ পড়ত সেখানে। এখন সেখানে হরদম ট্রলার চলাচল করায় ইঞ্জিনের বিকট শব্দে ইলিশ আসে না। ওই চ্যানেলে একজন জেলে এখন দিনে দু-একটি ইলিশও পাও যায় না।
দৌলতখান মদনপুরের জেলে রহমত মুন্সি (৮০) বলেন, ‘ইলিশ মাছ আইবো কোইত্তন (কিভাবে) ! নদীডার মাইদ্যে (মাঝে) যে পরিমাণ চর পড়ছে, বাডা (ভাটা) ওইলে হাডু (হাটু) পানি থাহে (থাকে)। এই পানিতে আইয়ে (আসে) সব জাটকা ইলিশ। হেগিন (সেগুলো) ধরি হালায় পিডাইন্যা জাইল্যারা। ওরা তো মাছেরে বড় অইতো দেয় না। আমরা পামু কুডে ?’
২৭ বছর ধরে মাছ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত দৌলতখান গুপ্তমুন্সি বাজারের ব্যবসায়ী আলম মাঝি (৫২) বলেন, নদীতে ডুবোচর রয়েছে। এতে পানির গভীরতা কমে যাওয়ায় ইলিশ আসতে চায় না। ইলিশ তাড়াচ্ছে ট্রলারের শব্দ। বর্ষাকালে আগে যে পরিমাণ বৃষ্টি হইতো, এখন তা হচ্ছে না। এই প্রাকৃতিক পরিবর্তনের কারণে জুন-জুলাই মাসেও ইলিশের দেখা নেই।
এ ব্যাপারে ভোলা সদর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কমকর্তা মোঃ আসাদুজ্জামান বলেন, ইলিশ মাছ চলাচলে যে পরিমান ¯্রােত প্রয়োজন নদীর তলদেশ ভড়াট হয়ে যাওয়ার কারণে ওই পরিমান ¯্রােত নেই। তাই ইলিশ চলাচলে বাধা সৃষ্টি হওয়ায় নদীতে ইলিশ কমে গেছে। তবে দু’এক সপ্তাহর মধ্যে ইলিশ কিছুটা বাড়বে বলেও জানান এ কর্মকর্তা।
দৈনিক দেশজনতা /এন আর