২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ৮:১৭

সারা দেশে একযোগে চলছে-‘তুফান’

মহিউদ্দিন খান মোহন

‘তুফান’ শব্দটির সাথে আমরা সবাই পরিচিত। আমাদের দেশে ঝড়-তুফান জোড়া শব্দ দিয়ে প্রকৃতির একটি রুদ্ররূপের কথাই বুঝানো হয়। গ্রামাঞ্চলে ঝড়কে সাধারণত তুফান নামেই অবহিত করা হয়ে থাকে। আর এ তুফান কারো কাছেই কাম্য নয়। কেননা, তুফান কখনো কখনো এমন রণচ-ী রূপ ধারণ করে যে, মানুষের বাড়ি-ঘর, গাছ-পালা সহায় সম্পদ সবকিছু ল-ভ- করে দিয়ে যায়। তাই তুফান কখনোই মানুষের কাছে সমাদর পায়নি। বরং কালবৈশাখীসহ সব ধরনের মৌসুমী তুফানের হাত থেকে বাঁচার জন্য সবাই সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে থাকে।
আমি এখানে প্রাকৃতিক তুফান নিয়ে আলোচনা করতে বসিনি। আমি যে তুফানের কথা বলতে চাচ্ছি সহৃদয় পাঠক নিশ্চয়ই তার কথা অনুমান করতে পারছেন। হ্যাঁ, আমি বগুড়ার সেই মানুষরূপী তুফানের কথাই বলছি, যে তছনছ করে দিয়েছে একটি মেয়ে ও তার মায়ের জীবন। তুফানের প্রবল ঝাঁপটায় সদ্য এস এস সি পাস কিশোরী সোনালী ও তার মায়ের সাজানো জীবন এলামেলো হয়ে গেছে। ইজ্জত-সম্ভ্রম হারিয়ে মা-মেয়ে এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ঘটনাটি এতাই প্রচারিত যে, তার পুনরুল্লেখ নিষ্প্রোয়জন। পত্র-পত্রিকা, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় এ নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালাচনা।
কিশোরীটিকে কলেজে ভর্তি করে দেয়ার আশ্বাস দিয়ে বাড়িতে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করেছিল তুফান। ইজ্জত হারিয়ে মা- মেয়ে বিচার চাইতে গিয়েছিল স্থানীয় মহিলা ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কাছে। বিচার তো মিললই না, উল্টো তাদের দু’জনকে ন্যাড়া করে দিল তুফান ও তার সন্ত্রাসী সহযোগীরা! আর এ বর্বরোচিত কাজে সহযোগিতা করলো বগুড়া পৌরসভার সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ড কাউন্সিলর মারজিয়া আক্তার রুমকি, যে নাকি তুফানের স্ত্রীর বড় বোন। উপায়ান্তর না দেখে মেয়েটির মা থানায় মামলা করেন। পুলিশ ইতোমধ্যেই ধর্ষক তুফান, তার স্ত্রী, স্ত্রীর বড়বোন রুমকি, শ্বাশুড়ি ও তুফানের কয়েকজন সহযোগীকে গ্রেফতার করেছে।
‘তুফান’ কোনো স্বাভাবিক নাম নয়। আমাদের দেশের মা-বাবারা সন্তানের নাম রাখার সময় ভেবে-চিন্তেই রাখেন। তুফানের মা-বাবা কেন তাদের সন্তানের এমন একটি ভয়ঙ্কর নাম রেখেছিলেন তা আমাদের জানার কথা নয়। হয়তো এ ছেলেটি জন্মের সময় তুফান হয়েছিল, যে জন্য এ নামকরণ। তবে, তুফান তার নামকরণের সার্থকতা প্রমাণ করেছে। সে তুফানের গতিতে যেমন রাজনীতির অঙ্গনে ঠাঁই করে নিয়েছে, তার চেয়েও অধিক গতিতে অর্থবিত্তের মালিক হয়েছে। সে সাথে পেয়েছে যা খুশি তা করার ক্ষমতা। ফলে কাউকে তোয়াক্কা করার কথা সে কখনোই ভাবেনি। ভেবেছে নিজেকে তার এলাকার রাজাধিরাজ, যে তার কৃতকর্মের জন্য কারো কাছেই বাধ্য ছিলনা।
প্রশ্ন উঠেছে একজন তুফান এতোটা বেড়ে উঠল কীভাবে? কারা তাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় মদদ দিয়ে আজকের তুফানে পরিণত হতে সাহায্য করেছে? তুফানের যে পরিচয় সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ-প্রচার হয়েছে তাতে দেখা যায়, সে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন শ্রমিক লীগের বগুড়া শহর শাখার আহ্বায়ক। ঘটনা প্রচারিত হওয়ার পর ওই পদ থেকে তাকে অব্যহতি দেয়া হয়েছে। তুফানর বাবা শহরে এক সময় চামড়া বেচাকেনা করত। সেও একই ব্যবসায়ে সম্পৃক্ত ছিল। বড়ভাই আবদুল মতিন সরকার বগুড়া শহর যুবলীগের প্রভাবশালী নেতা। তার সুবাদেই তুফান সরকার রাজনীতির পথে পর্দাপন করে এবং বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর নানা পথে অবৈধ উপার্জনে লিপ্ত হয়।
শহরের ব্যাটারি চালিত প্রায় ২০ হাজার অটোরিকশা ও ভ্যান থেকে প্রতিদিন লাখ লাক টাকা চাঁদাবাজী, ইয়াবা-ফেনসিডিলের ব্যবসা, জমি বেচাকেনায় চাঁদাবাজী ইত্যাদি থেকে সে আয় করতো লাখ লাখ টাকা। আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের স্থানীয় নেতারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে পত্রিকাকে বলেছেন, ক্ষমতাসীন দলের জেলার শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সখ্যের কারণে সে শহর শ্রমিক লীগের শীর্ষ পদটি পায়। তুফান সরকার খুন-ধর্ষণের মতো অপরাধের সাথেও জড়িত ছিল। এসব খবর তার দলের স্থানীয় নেতারা বা প্রশাসন জানতো না, তা নয়। তুফান তাদেরকে ম্যানেজ করেই চলতো।
এটাতো সহজেই বোধগম্য যে, ওপর মহলের আর্শীবাদ বা পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া একজন তুফানের ভয়ঙ্কর ‘টর্নেডো’তে রূপ নেয়া সম্ভব নয়। তুফান অবৈধ পথে যা আয় করেছে, তার ভাগ কি শাসক দলের বগুড়ার নেতারা পাননি? না পেলে শহরের চকযাদু সড়কে তুফানের নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধন কেন করবেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দিন? এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক একটি দৈনিকে প্রকাশিত ‘ ক্ষমতার তুফান বইছে’ শীর্ষক নিবন্ধে লিখেছেন, “ অপরাধীরা সাধারণত দুটি ভুল ধারণা থেকে অপরাধকর্মে জড়ান। প্রথমত, অপরাধীরা সাধারণত লোভ-লালসায় পড়ে অপরাধকর্ম করে থাকেন। তারা মনে করেন, চুরি-ডাকাতি বা অন্য অপরাধ করলেও ধরা পড়বেন না। আইন বা পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে তারা অপরাধের মাধ্যমে আয় করা টাকা বা সম্পদ ভোগ করতে পারবেন। দ্বিতীয়ত, অপরাধীরা এই ধারণা থেকে অপরাধ করে থাকেন যে, আইন তাদের ধরতে পারবে না অথবা পুলিশ বা আইন টের পেলে বা বুঝতে পারলেও ক্ষমতা, প্রতিপত্তি বা এ ধরনের কারণে তারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবেন। ইদানীং এই দ্বিতীয় শ্রেণীর অপরাধীদের খবরই পত্র-পত্রিকায় ঘন ঘন আসছে।…… বগুড়ার এই কিশোরী ধর্ষণকারী তুফান সরকার নিঃসন্দেহে দ্বিতীয় গোত্রের অপরাধী”( প্রথম আলো, ৩১ জুলাই, ২০১৭)।
ড. শাহদীন মালিকের বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণের অবকাশ নেই। রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলটির আশ্রয়ে প্রশ্রয়েই যে তার এতোটা বাড়-বাড়ন্ত সেটা ব্যাখ্যা করে বলার দরকার পড়েনা। একই পত্রিকার ১ আগষ্ট সংখ্যায় ‘ বগুড়ার অপরাধজগৎ দুই সরকারের হাতে’ শীর্ষক বিশেষ প্রতিবেদনে তুলে ধ‘রা হয়েছে তুফান সরকারের বড় ভাই যুবলীগ নেতা আবদুল মতিন সরকারের অপরাধের ফিরিস্তি। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে-‘ তুফানের বড় ভাই মতিন সরকার আরও খানিকটা এগিয়ে। তিনি র‌্যাবের তালিকাভূক্ত মাদক ব্যবসায়ী। একটি মামলায় তার ২৭ বছরের সাজা হয়। উচ্চ আদালতের নির্দেশে তা এখন স্থগিত আছে। পরিবহনে চাঁদাবাজী এবং রেলের জায়গা দখলের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। খুব অল্প সময়ে শত শত কোটি টাকার মালিক বনে যান। মতিন সরকার এখন জেলা ট্রাক মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আর শহর যবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।’ প্রতিবেনটিতে আরও বলা হয়েছে- ‘ এই দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে কেউ প্রকাশ্যে কথা বলেন না। তারা শহরে চলাফেরা করেন দলবল নিয়ে। বগুড়া শহরের সব মাদকের ঘাঁটি তাদের নিয়ন্ত্রণে।’
একটি বিষয় লক্ষণীয়। তাহলো, তুফানের অপকর্ম নিয়ে সারা দেশে নিন্দা-সমালোচনা তুফান উঠলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। এ বিষয়ে ১ আগষ্ট দৈনিক নয়া দিগন্ত-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বগুড়ার শ্রমিক লীগ নেতা তুফান সরকারের নেতৃত্বে নারী নির্যাতনের বর্বরোচিত ঘটনার প্রতিবাদে বিভিন্ন সংগঠন প্রতিবাদমুখর হলেও আওয়ামী লীগের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।’ তা না থাকারই কথা। দেশে সুশাসন কায়েম হয়েছে বলে উচ্চকণ্ঠে দাবিদাররা এখন কথা বলবেন কোন মুখে? তারা কি বলবেন তুফানকে তারা চেনেন না, বা তুফান তাদের কেউ না? শ্রমিক লীগের পদ থেকে বহিষ্কারের সাথে সাথেই প্রমাণ হয়ে গেছে তুফান কাদের সৃষ্টি, কাদের মদদে সে এতকাল অপরাধ করেও আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতে পেরেছে। এ বিষয়ে বগুড়ার দু’য়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা অবশ্য কিছুটা হলেও মুখ খুলেছেন। তারা বলেছেন, স্থানীয় কতিপয় প্রভাবশালী নেতার মদদেই তুফান সাইক্লোন রূপে আর্বিভূত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। বগুড়া জেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম একটি পত্রিকাকে বলেন,‘ তুফানের অপকর্মের বিষয়টি নিয়ে কাউকে মুখ দেখাতে পারছি না। তার সব অপকর্ম জানার পরও প্রভাবশালী কোনো কোনো নেতার আর্শীবাদ থাকায় এত দিন নিজেও অসহায় ছিলাম।’ বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে এম আছাদুর রহমান বলেন, তুফান সরকারের মতো লোকজনকে যারা দলীয় পদে বসান, ছাত্রী নির্যাতনের এই ঘটনায় তারাও সমান দায়ী।
সাম্প্রতিককালে সারা দেশে সংঘটিত অপরাধকর্মের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের সম্পৃক্ততা ভয়ঙ্করভাবে বেড়ে গেছে। বিশেষ করে খুন ধর্ষণের মতো মারত্মক অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে লীগ নেতাকর্মীরা। বগুড়ার তুফান সরকারের মতো বহু তুফানের তা-বে জনজীবন হয়ে উঠেছে অস্থির। এদের কাছে অসহায় প্রশাসন ও পুলিশ। দেশের আনাচে কানাচে বগুড়ার মতো অনেক ঘটনাই ঘটছে। নির্যাতিতরা প্রাণ হারানোর ভয়ে মুখ বুজে থাকছে, কেউ অপমানের জ্বালা সইতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে। শিশু কন্যাকে ধর্ষণের বিচার না পেয়ে গাজীপুরের সে অসহায় পিতার মেয়েসহ ট্রেনের নিচে পড়ে আত্মহত্যার ঘটনাতো আমরা কেউ ভুলে যাইনি। সে ঘটানার হোতারাও ছিল ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মী। বগুড়ার কিশোরী ও তার মা তাও পুলিশের কাছে নালিশ করে সাড়া পেয়েছে। গাজীপুরের অসহায় পিতাটি তাও পায়নি।
এ কোন সমাজে আমরা বসবাস করছি? যেখানে কিছু মানুষ হয়ে উঠেছে পশুরও অধম! যেখানে অন্যায়ের বিচার চাইতে গেলে উল্টো সম্মুখীন হতে হয় নির্যাতনের! ‘সুশাসন’ শব্দটি কি শুধু পত্র-পত্রিকা আর টিভি আলোচকদের কথায়ই সীমাবদ্ধ থাকবে? বাস্তবে কী তা ধরা দেবেনা? এ প্রশ্নগুলো শুধু আমার নয়, এ দেশের প্রতিটি সচেতন নাগরিকের। পত্র-পত্রিকার পাতায় কিংবা টেলিভিশনের পর্দায় রাষ্ট্রের কর্ণধারদের অনেক ভালো ভালো কথা আমরা শুনি। কিন্তু বাস্তবে তো তার কোনো প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়না।
আজ একজন তুফান সরকার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখেছি কীভাবে সে চামড়ার দোকানের সামান্য কর্মচারি থেকে সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিতে পরিণত হলো? কারা তাকে এই ভয়ঙ্কর ব্যক্তিতে পরিণত হতে মদদ যোগালো? রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসে থাকা প্রভাবশালীরা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য এ ধরনের তুফান তৈরি করে থাকেন। তাদের তৈরি করা তুফানরা এক সময় টর্ণেডোতে রূপ নিয়ে সমাজ-সংসারে বইয়ে দেয় ভয়াবহ ধ্বংসলীলা। সমাজ হয়ে ওঠে বসবাসের অযোগ্য।
সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে অশোক ঘোষ পরিচালিত একটি ছবি দেখেছিলাম। নাম ছিল ‘তুফান’। তখন রেডিওতে ছবিটির যে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হতো, তাতে বলা হতো-‘হ্যাঁ ভাই, একযোগে সারা বাংলাদেশে সগৌরবে চলিতেছে- অশোক ঘোষ পরিচলিত তুফান’। আজও সারা বাংলাদেশে দোর্দন্ড প্রতাপে চলছে তুফানদের ‘তুফান’। দেশবাসী সে তুফানদের দেখছে, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে তাদের ক্ষমতার দাপটের উত্তাপ। শুধু তাদের পরিচালকের নামটি কেউ মুখে আনতে পারছেনা।

লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

e-mail: mohon91@yahoo.com

 

প্রকাশ :আগস্ট ১০, ২০১৭ ১:১৫ অপরাহ্ণ