নিজস্ব প্রতিবেদক:
রাফি, আদনান ও ইমতিয়াজ একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএর তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। আদনান থাকেন হাজারীবাগে। রবিবার সকাল সকাল ক্লাস শেষ হয়ে যাওয়ায় বন্ধুদের নিয়ে যান হাজারীবাগে তাদের বাসায়। দুপুরের খাবার সেরে বিকেল গড়াতেই নৌকায় বুড়িগঙ্গা ঘোরার প্রস্তাব দেন তিনি।
কিন্তু রাফি ও ইমতিয়াজ কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। দুজনই জানতেন বুড়িগঙ্গা মানেই দুর্গন্ধযুক্ত কালো পানির নদী। আর যা-ই হোক ঘোরার জন্য বুড়িগঙ্গা, অসম্ভব! শেষমেশ বন্ধুর পীড়াপীড়িতে তাদের না আর টিকল না। কিন্তু ঘুরতে গিয়ে বুড়িগঙ্গা সম্পর্কে তাদের নেতিবাচক ধারণা অনেকটাই পাল্টে গেল। বরং বর্ষার বুড়িগঙ্গ দেখে তারা মুগ্ধ। রাফি ও ইমতিয়াজ বলেন, বর্ষার সময়ে বুড়িগঙ্গা যে এতটা সুন্দর হতে পারে, তাদের জানা ছিল না। পানি খুবই স্বচ্ছ, আগের মতো গন্ধ নেই। মনে হচ্ছে বুড়িগঙ্গা তার রূপ ফিরে পাচ্ছে।
বুড়িগঙ্গার দূষণে হাজারীবাগের ট্যানারির যে বড় একটা ভুমিকা ছিল সেটা অজানা ছিল না তাদের। তাই তাদের মতে, ট্যানারির নর্দমার দূষিত পানি কোনো রকম শোধন ছাড়াই সরাসরি নদীতে আসত, সেটা এখন আর আসছে না। ট্যানারি শিল্প সরিয়ে নেওয়ার ফলে একটা পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে বুড়িগঙ্গায়।
বিভিন্ন সময়ে পরিবেশবাদীদের জরিপে বলা হতো, আড়াইশ ট্যানারি চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের বিভিন্ন ধাপে প্রতিদিন প্রায় ৩০০ ধরনের ৫০ টন বিষাক্ত কেমিক্যাল ব্যবহার হতো। অ্যামোনিয়া, হাইড্রোজেন সালফাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, ক্লোরিন, ক্রোমিয়াম, ফরমিক অ্যাসিড, সালফিউরিক অ্যাসিড, অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড ও ক্যালসিয়াম হাইড্রোক্সাইড ব্যবহারের পর কোনো রকম পরিশোধন ছাড়াই নালার মধ্য দিয়ে বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়ত। হাজারিবাগে ট্যানারি বন্ধ হওয়ায় গত সাড়ে তিন মাস ধরে সেসব দূষিত কেমিক্যাল বুড়িগঙ্গায় আর পড়ছে না। তাতেই প্রাণ ফিরে পাচ্ছে নদীটি।
ঢাকার ঐতিহ্যবাহী এই নদীর বুকে এখন টলটলে পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। জেলেদের জালে ধরা পড়ছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। বিকালে মানুষজন নৌকায় করে বুড়িগঙ্গার বুকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বহুদিন পর বুড়িগঙ্গায় প্রাণের স্পন্দনে ঢাকা যেন তার ঐতিহ্য আবার ফিরে পেতে চলেছে।
একদিন এই বুড়িগঙ্গা ধরেই গড়ে ওঠে ঢাকা। ১৮ শতকের গোড়ার দিকে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক আবাসিক প্রতিনিধি জন টেইলর বুড়িগঙ্গার অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন, বর্ষাকালে যখন নদীটি পানিতে পরিপূর্ণ থাকে তখন দূর থেকে ঢাকাকে দেখায় ভেনিসের মতো।
এই বুড়িগঙ্গা একসময় শহরের মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্য ও জীবন-জীবিকার অন্যতম অবলম্বন ছিল। সারা দেশের সঙ্গে যোগাযোগের বড় মাধ্যম ছিল এই বুড়িগঙ্গা। এবার বর্ষার পানিতে টইটুম্বুর বুড়িগঙ্গা বহু মানুষের প্রাণে আশার স্বপ্ন জাগিয়েছে।
বুড়িগঙ্গায় ৩৫ বছর ধরে নৌকা চালান সত্তর বছরের মালেক মিয়া। তার চোখেও ধরা পড়েছে বুড়িগঙ্গার ইতিবাচক পরিবর্তন। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমার জীবনের অর্ধেকটাই তো এই নদীতে পার কইরা দিলাম। বলতে পারেন বড় হইছি বুড়িগঙ্গায়, ছোটবেলা থেকে নদীটারে কাছ থেকে দেখতেছি। কী নদী কী হইয়া গেল! তয় এখন একটা পরিবর্তন আইতাছে মনে হইতাছে। ট্যানারি বন্ধ করনে আগের মতো পানিতে গন্ধ লাগে না, পানিও আগের চেয়ে অনেক ভালা আছে।’
তবে মালেক মিয়া এ-ও বলেন, এখন তো বর্ষাকাল। প্রাকৃতিক পানি প্রবাহ বেশি। তাই ট্যানারি সরানোর প্রকৃত প্রভাবটা এখন পুরোপুরি বোঝা যাবে না। বর্ষা শেষে শুকনো মৌসুমে বোঝা যাবে প্রকৃত অবস্থা।
বৃড়িগঙ্গা পারের লোকজন অবশ্য বলছেন, গত এক যুগে যা হারিয়ে গিয়েছিল, তা আবার যেন ফিরে আসতে শুরু করেছে। বিশুদ্ধ পানির প্রবাহে নদীর চেহারাই পাল্টে গেছে। মানুষ নতুন করে দলে দলে নৌকা ভ্রমণের জন্য বুড়িগঙ্গায় আসছে।
বুড়িগঙ্গায় প্রাণ ফিরে পাওয়ার পর নৌকাচালকদের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে স্বস্তির আবহ। যারা নদীতে ভ্রমণ করতে আসেন, তাদের ঘুরিয়ে ভালোই রোজগার হচ্ছে মাঝিদের। কত দিন এ ধরনের নৌবিহারিদের আনন্দ দেখেননি তারা।
হাজারীবাগ এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা সফিউল আলম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ট্যানারি শিল্প সাভারে নিয়ে যাওয়ায় বুড়িগঙ্গার পানিতে পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। কয়েক মাসেই কিছুটা কমেছে পানির কালো বর্ণ ও গন্ধ। তবে এটা রাতারাতি বদলে যাবে না, ৩০-৪০ বছরের বর্জ্য অন্তত আরও দুই বছর লাগবে বুড়িগঙ্গার চেহারা ঠিক হতে।’ বুড়িগঙ্গার দুই পাড়ে অতিরিক্ত শিল্প-কারখানার ফলেই নদীর অবস্থা এতটা বিপর্যস্ত হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
লালবাগ বেড়িবাঁধের বাসিন্দা সোবহান মঞ্জুর ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমরা চাই বুড়িগঙ্গাকে আগের মতো দেখতে। এই নদী ঘিরে কত স্মৃতি এখনো মনে ভর করে। মিল ফ্যাক্টরি ও ঢাকার বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় ফেলা বন্ধ হলে সারা বছরই টলটলে পানি থাকবে বুড়িগঙ্গা।’
বুড়িগঙ্গা নিয়ে পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের স্বপ্নের শেষ নেই। তারাও চান নদীটি তার স্বরূপে ফিরে আসুক। বুড়িগঙ্গার মাঝেই তারা ঢাকার ঐতিহ্য খুঁজে পান।
২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বুড়িগঙ্গা নদীর দূষণের জন্য দায়ী মূলত শিল্পবর্জ্য। নদীতে পড়া বর্জ্যের ৬০ শতাংশ শিল্প খাতের। ৪০ শতাংশ ট্যানারি শিল্পের।
প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়, বুড়িগঙ্গা নদীতে প্রতিদিন ঢাকা শহরের চার হাজার ৫০০ টন আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। ২২ হাজার লিটার বিষাক্ত ট্যানারি বর্জ্য এ নদীকে হজম করতে হয়েছে এত দিন। এ ছাড়া পলিথিন জমে নদীটির তলদেশে ১০-১২ ফুট ভরাট হয়ে গেছে।
২০০১ সালে হাইকোর্ট চামড়াশিল্পসহ দূষণ সৃষ্টিকারী কারখানাগুলো এক বছরের মধ্যে দূষণ নিয়ন্ত্রণের নির্দেশ দেন।২০০৩ সালের ১৬ আগস্ট জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় অনুমোদন দেয়া হয় সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্পনগর প্রকল্প। কথা ছিল ২০০৫ সালের মধ্যে কাজ শেষ হবে। কিন্তু বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে কাজ শেষ না হওয়ায় প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ বাড়ানো হয় আরো পাঁচ বছর। তাতেও কাজ না হলে ২০১২ সাল পর্যন্ত ধরে দেয়া হয় প্রকল্পটির বাস্তবায়ন সময়সীমা। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সাভারে নিয়ে যাওয়া কথা থাকলেও সেটা সম্ভব হয়নি। এরপরও কেটে যায় আরও দুটো বছর। অবশেষে উচ্চ আদারতের কঠোর নির্দেশে হাজারীবাগের সব ট্যানারি কার্যক্রম ৮ এপ্রিল পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে ট্যানারির সব কার্যক্রম এখন চলছে সাভারের হেমায়েতপুরে।
বাংলাদেশে ১৯৪০ সালে নারায়ণগঞ্জে প্রথম ট্যানারি স্থাপন করা হয়। পরবর্তী সময়ে ট্যানারিটি স্থানান্তর করা হয় ঢাকার হাজারীবাগে। এই ট্যানারিকে কেন্দ্র করেই হাজারীবাগ এলাকায় গড়ে ওঠে প্রায় আড়াই শ ট্যানারি ইউনিট। প্রতিটি ট্যানারির নর্দমার দূষিত পানি কোনো রকম শোধন ছাড়াই সরাসরি গিয়ে মিশে যেত বুড়িগঙ্গা নদীতে।
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ