২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ৯:১৭

সংসদে সমাপনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী তিনি কিভাবে বললেন বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নেই

নিজস্ব প্রতিবেদক:

আইনের শাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেছেন, ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আমি জানি না আমাদের চিফ জাস্টিস কিভাবে বললেন- আইনের শাসন নেই, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নেই।’
প্রধান বিচারপতির সাম্প্রতিক বক্তব্য নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার মধ্যে গতকাল সংসদে পঞ্চদশ অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে এ কথা বলেন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা।
আদালতের বিচারকদের চাকরিবিধির গেজেট প্রকাশ নিয়ে দ্বন্দ্ব থেকে মার্চ মাসের মাঝামাঝিতে এক অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে তাকে পাশ কাটানোর অভিযোগ তোলার পর থেকে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য চলছে।
এর মধ্যেই গত ৩০ এপ্রিল এক অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায়’ বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিচার বিভাগ স্বাধীন। মাননীয় স্পিকার, আমি একটু আগে বললাম একজন নেত্রীর বিরুদ্ধে মামলায় ১৪০ দিন সময় চায়, আর সেটা দেয়া হয়। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আছে বলেই তো এই সময়টা দিতে পারছে। নাহলে তো দিতে পারত না।
‘আমাদের যদি কোনো মানসিকতা থাকত, তাহলে নিশ্চয় দিতে পারত না। আমরা তো সেটা করিনি। ইচ্ছামতো সময় দিয়ে গেছে, দিয়ে গেছে, দিয়েই যাচ্ছেন।’
এর আগে প্রধানমন্ত্রী জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের অর্থ আত্মসাৎ নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে চলমান মামলার বিষয়ে কথা বলেন।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘কথায় কথায় রিট। একই মামলায় যদি ৪০-৫০ বার রিট হয় আর যদি সেই রিট নিষ্পন্ন হয় তাহলে স্বাধীনতা নাই কিভাবে? এই একটা দৃষ্টান্তই যথেষ্ট। যারা এর সুযোগ নিচ্ছেন তারাও একসাথে তাল মিলাচ্ছেন আইনের শাসন নেই।’
প্রধান বিচারপতির বক্তব্য ধরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সোমবার এক সভায় বলেন, দেশে এখন আইনের শাসন নেই, বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করছে শাসন বিভাগ।
শেখ হাসিনা বলেন, আইনের শাসন আছে বলেই জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে সরকার।
‘আইনের শাসন আছে বলেই সেটা সম্ভব, নইলে সম্ভব নয়।’
অভিযানে জঙ্গিদের মৃত্যু নিয়ে সমালোচনার প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ‘এখন যদি জঙ্গিদের ধরা হয়, সেখানে কেউ মারা যায় সেটা মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়। এই একটা মানুষের জন্য হয়ত শত শত মানুষকে মৃত্যুবরণ করতে হতো কিংবা পঙ্গুত্ব বরণ করতে হতো।
‘তাদেরকে ধরলেই বা তারা নিজেরাই সুইসাইড করে বোমা ফেললেই… মরলেই আমাদের বিএনপির নেত্রীরও প্রাণ কাঁদে অন্যদেরও প্রাণ কাঁদে। কেন? যোগসূত্রটা কী? গোপন যোগাযোগ আছে কি না…’
বাংলাদেশে বাক-স্বাধীনতা নেই বলে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদন নিয়েও প্রশ্ন তোলেন সরকারপ্রধান।
‘দেখলাম অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, দেশে বাকস্বাধীনতা নেই। যারা এ রিপোর্টটা করছে তাদের বলব, টেলিভিশনগুলোতে বসে বসে দিনরাত আমাদের বিরুদ্ধে সমানে কথা বলা হচ্ছে। টক-শো, আলোচনা… একবারে স্বাধীনভাবে। সরাসরি কথা বলা হচ্ছে।’
‘কই কেউ কি গিয়ে গলা টিপে ধরে? কেউ তো তা করে না। সংবাদপত্র লিখেই যাচ্ছে। হ্যাঁ, কেউ যদি হলুদ সাংবাদিকতা করে, মিথ্যা-অসত্য তথ্য দেয়, কারও যদি চরিত্র হনন করে তারও অধিকার আছে যে, এখান থেকে কিভাবে সে প্রটেকশন পাবে। কারো বিরুদ্ধে যদি অসত্য তথ্য দেয়, সে যদি মানহানির মামলা করে, এটার জন্য দোষ কিভাবে দেবো?’
সমালোচনাকারীদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, ‘স্বাধীনতা নেই এটা যারা বলে, এই লোকগুলো এক সময় মনে করত একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি হলে তাদের মূল্য বাড়ে।
‘গণতান্ত্রিক পরিবেশে সেই সুযোগ কম থাকে। তাদের সাধ আছে ক্ষমতায় আসার। জনগণের কাছে ভোট চাওয়ার সাধ্য নেই। অনেকে চেষ্টাও করেছে। মানুষের কাছ থেকে সাড়া পাননি। এরাই নানা কথা বলে বেড়ায়।’
‘যারা বাকস্বাধীনতার কথা বলে…ইমার্জেন্সি থাকলে কী থাকে? যারা আমাদের বিরুদ্ধে বদনাম করেন, ইমার্জেন্সি সরকারের সময় বাকবাকুম বাকবাকুম করতে থাকে। কে তাদের ছিটায়ে দেবে, ওটা খাবে সেই আশায়। এটা তাদের চরিত্র।’
‘আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের বদনাম করা, এটাই তাদের চরিত্র। মনে হচ্ছে বদনাম করতে পারলেই কেউ নাগরদোলায় করে বসিয়ে দেবে ক্ষমতায়। সেই আশায় তারা থাকুক, সে আশার গুড়ে বালি।’
স্বাধীনতার সাথে দায়িত্বশীলতার কথা মনে করিয়ে দিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ‘অধিকার ক্ষণœ করা স্বাধীনতা না। স্বাধীনতা ভোগ করতে চাইলে তাকে দায়িত্ববোধ নিয়েই ভোগ করতে হবে। এটা হলো বাস্তবতা। আশা করি এটা সবাই মনে রাখবে।’
নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণসংক্রান্ত বিধিমালার গেজেট আড়াই বছরেও প্রকাশ না করায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত তথা সুপ্রিম কোর্ট। আদালত অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে জানতে চেয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট থেকে বঙ্গভবনের দূরত্ব কতদূর?
অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিধিমালা গেজেট আকারে প্রকাশ করতে সরকার ফের সময়ের আবেদন করলে গতকাল প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা এ মন্তব্য করেন।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা গতকাল প্রশ্ন রেখেছেন, সুপ্রিম কোর্ট থেকে একটি ফাইল বঙ্গভবন ও গণভবনে যেতে কত দিন সময় লাগে?
এর আগে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ গত ৪ এপ্রিল গেজেট প্রকাশের জনথ্য সরকারকে ৮ মে পর্যন্ত সময় দিয়ে বলেছিলেন, ওই সময়ের পর আদালত সরকারের আর কোনো ‘অজুহাত’ শুনবে না। কিন্তু অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম গতকাল আপিল বিভাগের কাছে আরো দুই সপ্তাহ সময়ের আবেদন করেন। এ বিষয়ে শুনানির পর প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগ গতকাল সরকারকে আরো এক সপ্তাহ সময় মঞ্জুর করেন।
সকালে আদালতের কার্যক্রম শুরুর পর অ্যাটর্নি জেনারেল একটি ফাইল উপস্থাপন করলে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এটা কি সময়ের আবেদন? আমরা তো ভেবেছি গেজেট।’ এরপর তিনি অ্যাটর্নি জেনারেলকে প্রশ্ন করেন- ‘বলেন তো, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শহর কোনটা?’ জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন- ‘টোকিও’। প্রধান বিচারপতি এ সময় বলেন, ‘আমি তো জানতাম নিউ ইয়র্ক।’ রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম এ সময় বলেন, ‘আপনার হিসেবে নিউ ইয়র্ক, আমার মনে হয় টোকিও।’
এ পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি প্রশ্ন করেন, ‘বলেন তো, নিউ ইয়র্ক থেকে টোকিও যেতে কত সময় লাগবে?’ অ্যাটর্নি জেনারেল চুপ করে থাকলে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমার তো মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শহর ঢাকা।’
তিনি আবার জানতে চান ‘সুপ্রিম কোর্ট থেকে বঙ্গভবন আর গণভবনের দূরত্ব কত?’ এবারো নিশ্চুপ থাকেন মাহবুবে আলম।
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমার মনে হয় ল মাইলেরও বেশি, কারণ একটি ফাইল সুপ্রিম কোর্ট থেকে বঙ্গভবন আর গণভবনে যেতে আড়াই বছরের বেশি সময় লাগে। মনে হয়, আড়াই বছরেও পাড়ি দেয়া যাবে না।’
সময় বাড়ানোর আদেশ দেয়ার আগে প্রধান বিচারপতি অ্যাটর্নি জেনারেলকে বলেন, ‘এর আগেও আপনি সময় চেয়েছিলেন, আমরা মঞ্জুর করেছি। আপনার কাছে এক সপ্তাহ, দুই সপ্তাহ যা, দুই বছরও একই।
উল্লেখ্য, মাসদার হোসেন মামলার চূড়ান্ত শুনানি করে ১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সরকারের নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে আলাদা করতে ঐতিহাসিক এ রায় দেন। ওই রায়ে আপিল বিভাগ বিসিএস (বিচার) ক্যাডারকে সংবিধান পরিপন্থী ও বাতিল ঘোষণা করেন। একই সাথে জুডিশিয়াল সার্ভিসকে স্বতন্ত্র সার্ভিস ঘোষণা করা হয়। বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করার জন্য সরকারকে ১২ দফা নির্দেশনা দেন সর্বোচ্চ আদালত।
মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পর ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা হয়ে বিচার বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়। আপিল বিভাগের নির্দেশনার পর গত বছরের ৭ মে আইন মন্ত্রণালয় নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিধিমালার একটি খসড়া প্রস্তুত করে সুপ্রিম কোর্টে পাঠায়। সরকারের খসড়াটি ১৯৮৫ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালার অনুরূপ হওয়ায় তা মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পরিপন্থী বলে গত ২৮ আগাস্ট শুনানিতে জানায় আপিল বিভাগ। এরপর ওই খসড়া সংশোধন করে সুপ্রিম কোর্ট আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। সেই সাথে তা চূড়ান্ত করে প্রতিবেদন আকারে আদালতে উপস্থাপন করতে বলা হয় আইন মন্ত্রণালয়কে। এরপর দফায় দফায় সময় দেয়া হলেও সরকার মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে ওই বিধিমালা গেজেট আকারে প্রকাশ না করায় গত ৮ ডিসেম্বর দুই সচিবকে তলব করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
দুই সচিবের হাজিরার আগে ১১ ডিসেম্বর আইন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে একটি নোটিশে বলা হয়, নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণসংক্রান্ত বিধিমালা গেজেট আকারে প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা নেই বলে রাষ্ট্রপতি ‘সিদ্ধান্ত’ দিয়েছেন।
আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের সচিব আবু সালেহ শেখ মো: জহিরুল হক এবং লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের সচিব মোহাম্মদ শহিদুল হক পরদিন আদালতের তলবে হাজির হলে প্রধান বিচারপতি বলেন, বিধিমালা নিয়ে রাষ্ট্রপতিকে ভুল বোঝানো হয়েছে। সেদিন শুনানি করে গেজেট প্রকাশের নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় দেয় আপিল বিভাগ। এরপর সরকার কয়েক দফা সময়ের আবেদন করে।

M/H

প্রকাশ :মে ৯, ২০১৭ ১১:৪৬ পূর্বাহ্ণ