২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ২:০৬

মৈনট ঘাটে একদিন

নিজস্ব প্রতিবেদক:

মৈনট ঘাট। নামটির মাঝেই যেন লুকিয়ে রয়েছে এক ধরনের কৌতুহল। অনেক আগে থেকেই যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু হয়ে ওঠেনি। অপেক্ষা সন্ধিক্ষণের। তবে এবার সুযোগ আর সুবিধার সম্মিলনে সে ইচ্ছা পূরণ হলো। যাই হোক দিনটি ছিল গত শুক্রবার। নানা বয়সী আমরা ১১ জন। সূর্যের আলোহীন মেঘাচ্ছন্ন ঢাকার আকাশ পানে চেয়ে প্রাইভেটকার যোগে মৈনট ঘাটের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু। ঢাকার কেরাণীগঞ্জর পার হয়েই গ্রামের দেখা। এ যেন- যান্ত্রিক কোলাহলপূর্ণ শহর থেকে প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যেতে আজ নেই কোনো মানা।

 বিস্তীর্ণ ধান ক্ষেতের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা পথধরে আমাদের গাড়ি চলছে। রাস্তার দুধারে গাছগুলোতে নতুন পাতা। কচি সবুজ পাতাগুলো যেন বাহবা জানাচ্ছে। গাড়ির জালানা দিয়ে দূরের গ্রামগুলো সহজেই চোখে পড়তে থাকল। মাঠজুড়ে সোনালী ধান। কোথাও কোথাও আবার ধান মাড়ায়ের কাজ চলছে। নানা দৃশ্য অবলোকন করতে করতে দুই ঘণ্টায় আমরা পৌঁছে যাই মৈনট ঘাটে।

জানা গেল, ঢাকার কাছেই পদ্মা নদীর তীরেই ঘুরে বেড়ানোর মজার জায়গা এই মৈনট ঘাট। মৈনট ঘাট ঢাকা জেলার দোহার উপজেলার অন্তর্গত। এপাড়ে দোহার আর ওপাড়ে ফরিদপুর। মৈনট ঘাট থেকে ফরিদপুরের গোপালপুরে স্পিড বোটে পারাপার হয় মানুষ। একসময় নাকি মৈনট ঘাট থেকে ফরিদপুর যাতায়াতের জন্য স্থানীয় কার্তিকপুর বাজার থেকে মৈনট ঘাট পর্যন্ত প্রশস্ত রাস্তা তৈরি করা হয়েছিল। সম্প্রতি রাস্তাটি পুনরায় মেরামত করা হয়েছে। সেই রাস্তাটি এসে ঠেকেছে মৈনট ঘাটে। ঢাকায় রোদ না থাকলেও মৈনট ঘাটে রোদের দেখা পাওয়া গেল। গাড়ি থেকে নেমেই চোখে পড়ল বিশাল পদ্মা। আর একটু সামনে গিয়েই দেখা গেল বিশাল জলরাশি।

সূর্যের আলোতে পানি ঝলমল করছে। বড় বড় ঢেউ এসে ধাক্কা লাগছে তীরে। তীর বেশ উঁচু। ঢেউয়ের ধাক্কায় আস্তে আস্তে তীরের মাটি পদ্মায় বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তীরে সাড়ি সাড়ি বাঁধা ছোট বড় নৌকা, ট্রলার, স্পিডবোট। সেগুলো মানুষ নিয়ে ছুটে চলছে পদ্মার বুকে। পদ্মার তীরে চাষ হচ্ছে চীনা বাদাম। বিস্তীর্ণ জায়গাজুড়ে বাদাম ক্ষেত। সবুজের বিশাল সমারোহ। সবুজ পেরিয়েই দেখা গেল পদ্মার তীরে গড়ে ওঠা গ্রামগুলো। ঘাটে ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে নানা ধরনের খাবারের দোকান। তবে পর্যটকদের থাকার জন্য মৈনট ঘাটের আশপাশে কোনো হোটেল, রিসোর্ট, বোডিং এখনো তৈরি হয়নি। কাজেই দিনে এসে দিনেই ফিরে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। রিভার ভিউ নামে একটি রেস্টুরেন্টে খাবারের কথা বলা হলো। তবে মৈনট ঘাটের মূল আকর্ষণ হলো পদ্মার মাঝে জেগে ওঠা চরে ঘোরাঘুরি এবং গোসল করা।

মৈনট ঘাট থেকে পদ্মায় ঘুরে বেড়ানোর ব্যবস্থা হলো স্পিডবোট। আটজনে যাওয়ার উপযোগী একটি বোটের ভাড়া ত্রিশ মিটিটের জন্য দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা। এছাড়া ছোট বড় নানান আকারের ইঞ্জিন নৌকাও আছে। আড়াইশ থেকে ৮শ’ টাকা ঘণ্টায় এসব ইঞ্জিন নৌকায় চার থেকে ২০/২৫ জন একসঙ্গে ঘুরে বেড়ানো যায়। অতঃপর ভাড়ায়চালিত ট্রলারযোগে চরের উদ্দেশ্য রওনা হওয়া গেল। উত্তাল পদ্মায় এগিয়ে চলছে ট্রলার।

পানির বড় বড় ঢেউয়ে দুলতে থাকল আমাদের ট্রলার। এমন উত্তালে ভয় পাওয়া অস্বাভাবিক নয়। ২০ মিনিট পর ট্রলার চরে এসে থামল। বিশাল জলরাশির মাঝখানে এক খণ্ডভূমি। সাদা বালি চিকচিক করছে। সূর্যের আলো যখন সাদা বালির উপর পড়ছে। তাকাতেই চোখ বেশিক্ষণ রাখা যায় না। তবে চরটি বেশি বড় নয়। চরটি নাকি আরো বড় ছিল। বর্তমানে কিছু অংশ পানির নিচে। তবে চরের মাঝখানের বালি প্রচণ্ড উত্তপ্ত। বেশিক্ষণ পা রাখা যায় না। নদীর তীরের বালি কিছুটা ভেজা। নানা বয়সী মানুষ চরের চারপাশে। কেউ গোসল করছে, কেউ আবার হাঁটছে। তবে পদ্মায় গোসল করার মজাই আলাদা।

ছোট ছোট ঢেউগুলো এগিয়ে আসছে। চর থেকে দেখা গেল, বিশাল জলরাশি। হেলেদুলে ভেসে বেড়ানো জেলেদের নৌকা। এ যেন এক সমুদ্রের ছোঁয়া। তবে অপরূপ জলরাশিই পদ্মার প্রধান সৌন্দর্য। বিস্তীর্ণ জলরাশি উপর দিয়ে জেলেদের সারি সারি নৌকা। ধরা পড়ে চিয়ারিত বাংলার রূপ। পদ্মার তীরে হেঁটে বেড়ানো। এ যেন কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে। যাই হোক মৈনট ঘাটকে ছোট কক্সবাজার বললে অত্যুক্তি হবে না। গোসল শেষে ফের ট্রলারযোগে মৈনট ঘাটে। এবার খাওয়ার পালা। পদ্মায় এসে ইলিশ না খেলে যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। পদ্মার সাথে যেন মিশে আছে ইলিশের ঘ্রাণ। রেস্টুরেন্টের লোকজন জানালেন, বেশির ভাগ মানুষেরই ইচ্ছা থাকে পদ্মার তীরে বসে পদ্মার সেই নামকরা ইলিশ খাওয়ার। তবে মৈনট ঘাটে বেশ কয়টি হোটেল আছে। তবে দামের ভিন্নতা রয়েছে। বিভিন্ন পদের ইলিশের রান্না পাওয়া যায়। যেমন- সরষে ইলিশ, ইলিশ ভাজা, ইলিশের ভর্তা। এছাড়াও বিভিন্ন মাছ ও মাংসের ব্যবস্থাও রয়েছে। তবে পদ্মর তীরে খাওয়ার মাঝে এক ধরনের ভিন্নতা রয়েছে। দীর্ঘদিন খুঁজে পাওয়া গেল ভিন্ন স্বাদের রান্না। সায়মনার নিচে খাওয়ার ব্যবস্থা। নেই কৃত্রিমতা।

মৈনট ঘাটে বেড়াতে গিয়ে পদ্মার মাছও কেনার সুযোগ আছে। তবে সকাল ছাড়া পাওয়া যায় না। তবে নৌকা নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ দেখা হওয়া জেলে নৌকা থেকে মাছও পাওয়া যেতে পারে। পদ্মার সেই টাটকা মাছের স্বাদ নিতে হলে দাম বেশ কিছুটা বেশিই গুনতে হয়। তবে মৈনট ঘাট দর্শনের উপযুক্ত সময় নাকি বর্ষাকাল। রাস্তার দুই পাশের নিম্নভূমি, যেখানে বর্ষার আগে বিস্তীর্ণ ভূমিজুড়ে বাদামের চাষ করা হয়, আর সবই বর্ষায় পদ্মার পানিতে তলিয়ে যায়। সে এক দেখার মতো দৃশ্য। তবে বর্ষার আগে এর সৌন্দর্যের কমতি নেই। তবে ফেরার পথে দেখা গেল নবাবগঞ্জের জজবাড়ি, উকিলবাড়িসহ আরো কিছু দর্শনীয় স্থান। যাই হোক মৈনট ঘাট এক সম্ভাবনাময় স্থান। যথাযথ পদক্ষেপে এটি হতে পারে পর্যটকদের অন্যতম বিনোদন কেন্দ্র। এর বিকাশে চাই যথেষ্ট প্রচার এবং প্রসার।

প্রকাশ :মে ৯, ২০১৭ ১১:২৬ পূর্বাহ্ণ