২৫শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ১০ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ৪:১২

প্রকট হচ্ছে মহানগরীর জলাবদ্ধতা, সমন্বিত কর্মোদ্যোগ নেই

নিজস্ব প্রতিবেদক:

জলাবদ্ধতা রাজধানী ঢাকার জন্য একটি মহাযন্ত্রণার নাম। এতে মূলত নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হয় বেশি। পুরোনো এই সমস্যা নিরসনে বিভিন্ন সময়ে নানা প্রকল্প নেয়া হয়েছে বটে, কিন্তু সমাধানের বদলে দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে তা।

রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিয়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো এখন একে-অপরের ওপর দোষারোপ করছে। ওয়াসা বলছে জলাবদ্ধতার জন্য তারা দায়ী নয়। সিটি করপোরেশন বলছে ওয়াসাই দায়ী। অন্যদিকে নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে দরকার সমন্বিত কর্মোদ্যোগ। এক-অপরকে দোষারোপ করে এ্ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। কিন্তু সমন্বিত কর্মোদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না কোথাও।

ঢাকার পরিকল্পনা বলতে জানা যায় ১৯৫৯-৬০ সালের একটি পরিকল্পনার কথা। ওই মাস্টার প্ল্যানে ঢাকার চারপাশের নিম্নাঞ্চল ও নদী, শহরের খাল, বিল, ঝিল— এসব রেখেই উন্নয়ন পরিকল্পনা ছিল। অর্থাৎ একধরনের জলের সঙ্গে বসবাসের পরিকল্পনা। কিন্তু আশির দশকে এসব বিবেচনায় না নিয়ে একধরনের লাগামছাড়া নগরায়ণ শুরু হয়। তাতে সমস্যা আরও বেড়ে যায় বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।

সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, কয়েক দিনের টানা বর্ষণে তলিয়ে যায় রাজধানীর অনেক এলাকা। খিলক্ষেত, মতিঝিল, মালিবাগ, শান্তিনগর, যাত্রাবাড়ী, রায়েরবাগ, কাজলা, শাহজাহানপুর, মোহাম্মদপুর, আজিমপুর, ধানমণ্ডিসহ বিভিন্ন এলাকায় দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। রাজধানীর এ জলাবদ্ধতার জন্য সিটি কর্পোরেশন ও ওয়াসাসহ সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করছেন নগরবিদরা। বৃষ্টিতে রাজধানীতে জলাবদ্ধতা স্বাভাবিক ঘটনা হলেও গত কয়েক দিন নজিরবিহীন জলাবদ্ধতা দেখছে নগরবাসী।

নগর পরিকল্পনাবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জলাবদ্ধতার সমস্যা সমাধানে স্যুয়ারেজ ও ড্রেনেজ সিস্টেমকে একক কর্তৃত্বে নিয়ে আসতে হবে। উন্নয়নকাজে সমন্বয় আনতে সংশ্লিষ্ট ১৪টি সরকারি সংস্থাকে নিয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠনের মাধ্যমে মহাপরিকল্পনা তৈরি এবং সে অনুযায়ী কাজে নেমে পড়তে হবে। এ ছাড়া জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধানে জনগণের সম্পৃক্ততা এবং সচেতনতা বাড়ানোর বিষয়টি রয়েছে। কিন্তু সরকারি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতার কারণে এসব পরামর্শ আদৌ বাস্তবায়ন হয়নি।

রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিয়ে সাম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাইদ খোকন বলেছিলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে ঢাকা ওয়াসা ব্যর্থ। ওয়াসা কর্তৃপক্ষ তাদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করতে পারছে না। তাদের কারণে নগরীর মানুষের চরম দুর্ভোগ হচ্ছে।

সাঈদ খোকন আরো বলেন, ‘নগরীর খাল রক্ষার দায়িত্ব ওয়াসার। অথচ খাল দখল হচ্ছে। নগরীতে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। দায় আসছে আমাদের ওপর।’

রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য পুরোদমে কাজ শুরু করা হয়েছে। ড্রেনগুলো পরিষ্কার রাখার জন্য ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘জেট অ্যান্ড সাকার’ মেশিন কেনা হয়েছে। এটা প্রতিদিন কাজ করছে। কিন্তু রাজধানীর জলাবদ্ধতা কেবল ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মেয়রদের পক্ষে নিরসন করা সম্ভব নয়। জলাবদ্ধতা নিরসন কাজের সঙ্গে ১৪টি সংস্থা সম্পৃক্ত। খাল উদ্ধারের দায়িত্ব জেলা প্রশাসক ও ঢাকা ওয়াসার।

রাজধানীর জলাবদ্ধতা জন্য ওয়াসার দায় অস্বীকার করছেন সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাসকিম এ খান। তার মতে, মূলত বক্স কালভার্টের কারণেই এই জলাবদ্ধতা। আর রাজধানীর নিচু এলাকায় অবাধে অট্টালিকা গড়ে ওঠা।

তাসকিম খান বলেন, ‘জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হলেই ওয়াসাকে দুষবেন এটা হতে পারে না। জলাবদ্ধতার জন্য প্রধানত রাজাধানীবাসীও দায়ী। কারণ তারা সচেতন নন। এ জন্য ওয়াসা কোনো সংস্থাকে দোষারোপ করছে না। বিভিন্ন খালে অবৈধভাবে দালান তৈরি ও ময়লা ফেলার কারণে খাল ও ড্রেনগুলোতে জট তৈরি হয়েছে। নগরবাসী ড্রেনেজ লাইনেই পয়োবর্জ্য ফেলছে।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, এই সমস্যার সমাধান মূলত সমন্বিত কর্ম-উদ্যোগ এবং সময়নির্ভর বাস্তবায়ন। এই কাজ না করলে কোনোভাবে ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতার সমাধান হবে না। হাঁটুপানিতে দাঁড়িয়ে যদি প্রতিশ্রুতি দেন আর জলাবদ্ধতা হবে না, এটি কোনো সমাধান না।

ইকবাল হাবিব বলেন, বৃষ্টির পানি যেটুকু নদী পর্যন্ত যাবে, ততটুকু পানি ‘রান অব ওয়াটার’ হয়ে যায়। অর্থাৎ বৃষ্টির পানির যে অংশটুকু আমরা ধারণ করি তা বাদ দিয়ে বাকিটাকে বলে রান অব ওয়াটার। নগরী অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠার কারণে এই রান অব ওয়াটারের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। আগে মাঠ-ঘাট বিল-ঝিলে পানি দাঁড়াতো, পানি চুয়ে চুয়ে নিচে নামত। কিন্তু এখন সব দখল করে পাকা করে ফেলেছে। ফলে রান অব ওয়াটারের পরিমাণ বেড়ে গেছে।

ইকবাল হাবিব বলেন, একই সঙ্গে খাল-বিল ছিল, ড্রেনেজ ছিল যেগুলো পাঁচ-আট বছর আগে করা, সেগুলো প্রত্যেকটাকে সার্বিক অঙ্গ হিসেব দেখানো হয়েছে। সেগুলোকে রক্ষা করলাম না, দখল হয়ে গেল, কঠিন বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত হলো। তাহলে তো স্বাভাবিকভাবেই রান অব ওয়াটারের যাত্রা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বাধাগ্রস্ত হলেই জলজট, দীর্ঘ সময় জলজট হলেই জলাবদ্ধতা।

ইকবাল হাবিব বলেন, ওয়াসা গত চার বছর ধরে বলছে এটা তাদের দায়িত্ব না। এটি যে কত অন্যায়। কারণ ড্রেনেজ ব্যবস্থা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ছিল। সিএন্ডবি ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের পরস্পর সহযোগিতা করে সিটি করপোরেশনের ড্রেনেজ করেছিল। আশির দশকে বড় কালভার্ট প্রজেক্টের ফান্ড এল কোটি কোটি টাকার। তখন ওয়াসা নিজের কাজ বাদ দিয়ে ড্রেনেজ ডিভিশন খুলে এই ড্রেনেজ তাদের কাছে নিয়েছে। এর ফলে পুরো ঢাকা ড্রেনেজ সিস্টেমের মাস্টার প্লান তৈরি করা, সেটার কার‌্যক্রম পরিচালনা করা ওয়াসার ওপর বর্তায়। সবগুলো ওয়াসা কর্তৃক তৈরি করা। সেই ওয়াসা অস্বীকার করছে। ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থা মূলত সমন্বয়হীনতার চরম নিদর্শন বলে মন্তব্য করেন ইকবাল হাবিব।

এই স্থপতি বলেন, রাজধানীর পানি নিষ্কাশনের পাম্পগুলো নিয়ে ওয়াটার ডেভেলপমেন্টের তেমন কোনো কার্যক্রম নেই। আবার খালগুলো জেলা প্রশাসকের দায়িত্বে। এখানে সমন্বিত সার্বিকতা নির্ভর, সময়নির্ভর কর্মধারা গ্রহণ করা প্রয়োজন। সবশেষে জনগণকে সম্পৃক্ত করেই এটা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ

প্রকাশ :জুলাই ১৫, ২০১৭ ১২:০৫ অপরাহ্ণ