২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ৯:১৩

সিলেটে ফুড সাপ্লিমেন্ট প্রতারণায় রোগীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক:

সিলেটের চিকিৎসকরা ওষুধ প্রশাসনের আইন মানছে না। নির্ধারিত আইন অমান্য করে তারা ব্যবস্থাপত্রে ভেজাল ও নিম্নমানের ফুড সাপ্লিমেন্ট লিখছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফলে প্রতারিত হচ্ছনি সাধারণ রোগীরা। এতে যেমন বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি, তেমনি আর্থিক ক্ষতিতে পড়তে হচ্ছে ভুক্তভোগী পরিবারকে।
ওষুধ প্রশাসনের পক্ষ থেকে নগরীর বিভিন্ন ফার্মেসিতে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করলেও এসব চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ে মাঠে নেমেছে ওষুধ প্রশাসন। তবে প্রশাসন বলছে, চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করার কোনও নিয়ম তাদের নেই। ব্যবসায়ীরা বলছেন, চিকিৎসকরা ব্যবস্থাপত্রে যে ওষুধ লিখছেন তাই তারা বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিভিন্ন ফুড সাপ্লিমেন্ট কোম্পানির প্রতিনিধিরা এক শ্রেণির চিকিৎসককে প্রভাবিত করে রোগীদের ব্যবস্থাপত্রে এগুলো লিখিয়ে নিচ্ছে। এক্ষেত্রে মোটা অংকের টাকা অনেক চিকিৎসককে দেয়া হচ্ছে বলেও জানা গেছে। কিছু কিছু কোম্পানি ওষুধ প্রশাসনের দেওয়া বৈধ লাইসেন্সের আড়ালে নামে-বেনামে অবৈধ ওষুধ ও ফুড সাপ্লিমেন্ট বাজারজাত করে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য করছে। এসব ফুড সাপ্লিমেন্ট কিনে চিকিৎসা সেবার নামে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন রোগীরা। পড়ছেন স্বাস্থ্য ঝুঁকিতেও।
নগরীর বিভিন্ন ফার্মেসির ওষুধ বিক্রেতাদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, চিকিৎসকরা এখনো ব্যবস্থাপত্রে ফুড সাপ্লিমেন্ট লিখে যাচ্ছেন। এমনকি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা অনেক রোগীকে ওষুধের পাশাপাশি ফুড সাপ্লিমেন্ট দেয়া হচ্ছে বলেও তাদের অভিযোগ। তারা আরো জানান, একশ্রেণির লোভী চিকিৎসককে ম্যানেজ করে ফুড সাপ্লিমেন্ট কোম্পানিগুলো পণ্য বাজারে ছাড়ছে। অত্যাধুনিক মোড়কে প্লাস্টিক বোতলভর্তি বিদেশি ফুড সাপ্লিমেন্ট আসছে বৈধ ও অবৈধ পথে। অবশ্য ব্যবস্থাপত্রের বাইরেও এগুলো বিক্রি হচ্ছে বলে জানা গেছে। ওষুধ বিক্রেতারা জানায়, শতকরা ৭০ ভাগ ব্যবস্থাপত্রেই একাধিক ফুড সাপ্লিমেন্টের নাম লেখা থাকে। যেহেতু ডাক্তাররা ব্যবস্থাপত্রে লিখে দিয়েছেন তাই কিনতে বাধ্য হচ্ছেন রোগীরা।
এ ব্যাপারে অভিযোগ পাওয়া একাধিক চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান, এসব ফুড সাপ্লিমেন্ট নিষিদ্ধ তারা জানেন না। এমকি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকেও তাদের অবগত করা হয়নি। অনেক সময় রোগীদের অনুরোধে তারা ব্যবস্থাপত্রে লিখে থাকেন বলেও জানান চিকিৎসকরা।
চিকিৎসকরা বলেন, বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা তাদের এ ফুড সাপ্লিমেন্ট গুনাগুন ভালো বলে তাদেরকে অবহিত করে। এ জন্য রোগীদের ব্যবস্থাপত্রে এ সব দেওয়া হয়।
যেহেতু এসব নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেহেতু এটি দেশে আমদানি করা বন্ধ করলে কেউ আর ব্যবস্থাপত্রে এটি লিখবে না বলেও জানান চিকিৎসকরা। ফুড সাপ্লিমেন্ট যেহেতু নিষিদ্ধ তাই ব্যবস্থাপত্রে এগুলো আর লিখবেন না বলে প্রতিবেদককে অবহিত করেন চিকিৎসকরা।
এ ব্যাপারে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগের সাবেক এক সহকারী অধ্যাপক সংবাদকর্মীকে বলেন, রোগী হলে চেয়ারে বসেন, রোগী না হলে বেরিয়ে যান।
সাংবাদিক পরিচয় দিলে তিনি বলেন, কোন বিষয়ে আলাপ করতে চান। রোগীর ব্যবস্থাপত্রে ফুড সাপ্লিমেন্ট দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চাই না, যা ইচ্ছা লিখতে পারেন।ওষুধ প্রশাসন সিলেটের ড্রাগ সুপার শফিকুর রহমান জানান, ফুড সাপ্লিমেন্টের উৎপাদন ও বিক্রি করার অনুমতি ওষুধ প্রশাসন দেয়নি। ভেজাল ও নিম্নমানের এসব ফুড সাপ্লিমেন্ট বিক্রি বন্ধ করতে নগরীর ফার্মেসিগুলোতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি ফার্মেসিকে জরিমানাও করা হয়েছে।
তিনি আরো জানান, চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করার ক্ষমতা ওষুধ প্রশাসন বিভাগের নেই। যার কারণে আমরা তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতে পারছি না।
সিভিল সার্জন ও বিএমএ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে বলেও জানান তিনি।এ ব্যাপারে সিলেটের সিভিল সার্জন ডা. হিমাংশু লাল রায় বলেন, ফুড সাপ্লিমেন্ট কোনও ওষুধ নয়। এটা খাদ্যের বিকল্প হিসেবে অনেকে খেয়ে থাকেন। দেশে কোনও ওষুধ বিক্রি বা উৎপাদন করতে হলে ওষুধ প্রশাসনের যেমন অনুমতি লাগে, ঠিক তেমনি খাদ্য জাতীয় কোনও কিছুর ক্ষেত্রে অনুমতি নিতে হয় খাদ্য অধিদপ্তরের। ফুড সাপ্লিমেন্ট উৎপাদন ও বিক্রি করার অনুমতি এ দুই প্রতিষ্ঠান দেয়নি। তাই দেশে এসব বিক্রি বা বিপণন করার অনুমতিও নেই। তাই কোনও চিকিৎসকদের এটি রোগীদের দেওয়া ঠিক না।এসব বন্ধে গত আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় তিনি আলোচনা করেছেন বলেও জানান ডা. হিমাংশু লাল রায়। সিভিল সার্জন জানান, কিছু অসাধু চিকিৎসককে ম্যানেজ করে ফুড সাপ্লিমেন্ট কোম্পানিগুলো তা রোগীর ব্যবস্থাপত্রে লিখিয়ে নিচ্ছে। আগামী বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) এর সভায় তিনি এ বিষয়ে সবাইকে অবহিত করবেন। সেখান থেকে ডাক্তারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।সিলেট স্বনামধন্য কিছু চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্র পড়ে দেখা গেছে, বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের পাশাপাশি লেখা হয়েছে ফুড সাপ্লিমেন্ট।
সবচেয়ে ভয়াবহ তথ্য হচ্ছে, প্রয়োজন না হলেও তাদেরকে শুধু ফুড সাপ্লিমেন্ট দেওয়া হচ্ছে। সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগের সাবেক সহকারী অধ্যাপক তার ৬ জুলাইয়ের একটি ব্যবস্থাপত্রে দেখা গেছে, তিনি এক রোগীকে ‘পোলেন সি আর’ নামের একটি ফুড সাপ্লিমেন্ট লিখে দিয়েছেন। তাছাড়াও একই মেডিকেলের একজন গাইনী বিশেষজ্ঞ ২৭ মে’র একটি ব্যবস্থাপত্রে এক রোগীকে ‘ফিলা’ নামের একটি ফুড সাপ্লিমেন্ট লিখে দিয়েছেন। এছাড়া জালালাবাদ রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজের গাইনী বিভাগের এক অধ্যাপকের ব্যবস্থাপত্রে দেখা গেছে, তিনি এক রোগীকে তিনটি ফুড সাপ্লিমেন্ট লিখে দিয়েছেন। যার মধ্যে রয়েছে, এক্সটিমিন, ভেলিডো, ই-গ্রেইস, নামের নিষিদ্ধ ফুড সাপ্লিমেন্ট।
বক্ষব্যাধি হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্টের ব্যবস্থাপত্রে দেখা গেছে, তিনি ৮ জুলাইয়ের একটি ব্যবস্থাপত্রে ‘বায়োবিলোভা’ নামের ফুড সাপ্লিমেন্ট দিয়েছেন। একইভাবে সিলেটের সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসকরা নিওভিট, ইভ১০০০, ফ্লেক্সিমেক্স, নিওলিন, ভায়োটিনসহ বিভিন্ন নামের নিষিদ্ধ ভেজাল ওষুধ রোগীদের ব্যবস্থাপত্রে লিখছেন।
উল্লেখ্য, ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ ১৯৮২-এর ১৪ (এ) (১) উপ-ধারায় বলা আছে, রেজিস্ট্রিবিহীন ওষুধ রোগীর ব্যবস্থাপত্রে কোনও চিকিৎসক লিখতে পারবেন না। কোনও চিকিৎসক এ ধরনের ওষুধ ব্যবস্থাপত্রে লেখেন, তাহলে সেটা আইনবিরোধী হবে। এতো সব জানা সত্ত্বেও এ ধরনের অবৈধ ফুড সাপ্লিমেন্ট ব্যবস্থাপত্রে লেখা হচ্ছে।

দৈনিকদেশজনতা/এন এইচ

প্রকাশ :জুলাই ১৩, ২০১৭ ৫:২৬ অপরাহ্ণ