২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ৩:২৩

নির্বাচন নিয়ে ভাবনা

এ.কে.এম শামছুল হক রেনু:

যে কোন নির্বাচনে জয়পরাজয় আছেই। অর্থাৎ একজন জিতবে, আরেকজন হারবে, একদল জিতবে, আরেক দল হারবে। গণতান্ত্রিক রীতির এটাই বাস্তবতা। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, গণতান্ত্রিক সরকার ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতির কোনভাবেই এর বাইরে যাওয়ার আদৌ কোন সুযোগ নেই। যদি কোন ব্যক্তি ও দল এ প্রবিধানের বাইরে চলে যায়, তখনই সেটা অগণতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্রের রাজনীতির নামান্তর হয়।

২০১৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জেলা পরিষদের নির্বাচন আইয়ুবী মৌলিক গণতন্ত্রের আদলে অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে এটাকে দেশের মানুষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতির নির্বাচন বলে মনে করেনা। অপরদিকে ২০১৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ না করলে সে দলের রেজিষ্ট্রেশন বাতিল হয়ে যাবে যারা বলে থাকেন তাও কোন যুক্তিতে আসেনা। কারণ এটা দলের নিজস্ব ব্যাপার। সবকিছুতে শেষ আছে এবং খোঁড়া যুক্তি দাঁড় করিয়ে বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে অস্বীকার করা অগণতন্ত্রেরই নামান্তর। গণতান্ত্রিক রাষট্র ও সরকারের কাছে যে কোন দল বা ব্যক্তির কিছু বক্তব্য থাকতেই পারে। তাই বলে খোঁড়াযুক্তি দাঁড় করানোকে গণতন্ত্র কোন অবস্থাতেই তা মেনে নেয়না। গণতন্ত্র একটি বিশাল বট গাছ। যার ডালপালা সুবি¯তৃত, সুবিন্যস্ত ও সম্প্রসারিত। তাছাড়া গণতন্ত্র হচ্ছে জনগণের দ্বারা জনগণ কর্তৃক ও জনগণের জন্য পরিচালিত সরকার ব্যবস্থা।(Goverment of the people, by the people and for the people).         

সভ্য সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় ইবলিশ ও পাগল ছাড়া কেউ স্বৈরাচারের ধ্বজাধারী হতে পারে না। ইবলিশ ও পাগল পেছনে তাকায় না বলেই পরিণতির কথা চিন্তা করে না। ইতিহাসের জনক হেরিডোটাস লিখেছেন, গণতন্ত্র বিমুখ স্বৈরাচার ও এক নায়েকের পরিণতি ভয়াবহ ও মর্মান্তিক। হিটলার, মুসোলিনি, জার, চেংগিস খান, হালাকু খান, তৈমুর লং, চসেস্কুর উত্থান ও পতনকে অনেকেই উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করে থাকে। ২০১৯ সালে দেশে আবার সাধারণ নির্বাচন আসছে। দেশের মানুষ যেমনি আর একতরফা নির্বাচন দেখতে চায়না, তেমনি ভোটার বিহীন এমপি, পার্লামেন্ট ও “সিল মার ভাই, সিল মার” এমন স্লোগান দিয়ে প্রিসাইডিং ও পোলিং এজেন্টদেরকে বের করে ব্যালট পেপারে সিল মেরে কেন্দ্র দখলের তান্ডব আর দেখতে চায়না। যার প্রমাণ মেলে ১৯৮৬, ৮৮, ৯৬ এর ১৫ ফেব্রুয়ারী ও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর দেশের সাধারণ নির্বাচনে। তারপর অনেক সিটি কর্পোরেশন, উপজেলা, ইউপি, পৌরসভা ও মৌলিক গণতন্ত্রের আদলে অনুষ্ঠিত জেলা পরিষদের একতরফা নির্বাচনের কথা নাইবা বললাম।
দেশের মানুষ কামনা করে সব দলের অংশগ্রহণে “আমার ভোট আমি দিব যাকে খুশি তাকে দিব” ইসির গতানুগতিক স্লোগানকে কথায় নয় কাজে রূপান্তরিত করা। তারা চায় গণতান্ত্রিক আদলে অবাধ, নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ এবং দেশ বিদেশের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। একজন নির্বাচিত সংসদ সদস্য সাংবিধানিকভাবে বিশাল ক্ষমতার অধিকারী। তদুপরি তার মর্যাদা একজন সচিব ও ক্যাবিনেট ডিভিশনের সচিবের উপরে। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, বর্তমানে অনেক সংসদ সদস্যই নিরাপত্তার জন্য সাথে পুলিশ প্রটেকশন নিয়ে থাকেন। এ অবস্থা অতীতে ছিল না। কারণ জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্যসহ যে কোন জনপ্রতিনিধির প্রটেকশন হচ্ছে এলাকার জনগণ। যদি সেই প্রতিনিধি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে থাকেন।
বর্তমানে রাজনীতি এবং নির্বাচন যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে এসব শিক্ষা থেকে এটাই মনে হয়, যেন আকাশ পাতাল ব্যবধান। তাছাড়া বর্তমানে রাজনৈতিক নেতা, এমপি, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের হাবভাব দেখে অনেকেই মনে করে এখন কেমন যেন কথাবার্তায়ও একের প্রতি অপরের সৌজন্যবোধ হারিয়ে যেতে বসেছে। এই অবস্থা থেকে যতদিন বের না হওয়া যাবে ততদিন দেশের কল্যাণ, উন্নয়ন, স্বচ্ছ, সুন্দর রাজনীতি থেকে আমাদের বঞ্চিত থাকার সম্ভাবনাই বেশী। একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ১৯৭৩ সালে দেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যবসায়ী সংসদ সদস্যের সংখ্যা ছিল ১৫ শতাংশ, ১৯৭৯ সালে ৩৫ শতাংশ, ১৯৯৬ সালে ৪৮ শতাংশ, ২০০১ সালে ৫১ শতাংশ, ২০০৮ সালে ৬৩ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে এটা দাঁড়ায় ৬৯ শতাংশে। ফলে রাজনৈতিক চালিকা শক্তি হিসেবে যেমনি ব্যবসায়ীদের সংখ্যা বাড়ছে, তেমনি প্রকৃত ত্যাগী ও রাজনীতিকদের সংখ্যা কমছে। ফলে রাজনীতির ধারা বিবর্তিত হয়ে ত্যাগের রাজনীতি আজ ভোগের রাজনীতিতে পরিণত হচ্ছে। যার ফলে রাজনীতিকদের মুখে অনেক সময় অশোভনীয় শব্দ ও বাক্য চয়ন, এক ধরণের মিথ্যাচারের সংস্কৃতি এবং একে অপরকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ ও ঘায়েল করার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে করে দেশের মানুষের কাছে রাজনীতিকদের ব্যক্তিত্ব ও সম্মান দিনের পর দিন গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে। এক সময় যেখানে মহৎ ও বিখ্যাত মানুষরা রাজনীতির সাথে যুক্ত থেকে দেশের কল্যাণ ও উন্নতির কথা চিন্তা করতেন আজ ব্যক্তিত্ব ও সম্মান ক্ষুন্ন হওয়ার কথা চিন্তা করে অনেকেই রাজনীতির সাথে যুক্ত হতে চাননা। তদুপরি গণতান্ত্রিক ধারায় যে রাজনীতি হওয়ার কথা তার আজ বড়ই আকাল। একসময় কে নির্বাচন কমিশনার হল বা কে সিইসি হবে এ নিয়ে কারো কোন মাথা ব্যাথা ছিল না। কারণ এ পদটি রাষ্ট্রের নিরপেক্ষ ও সাংবিধানিক। কারণ তারা ছিলেন বাস্তবিকই নিরপেক্ষ। ম্যাকিয়াভেলি ও এ্যারিস্টটল তাদের রাজনৈতিক সম্পর্কিত গ্রন্থগুলোতে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
২৬ এপ্রিল বুধবার বিভিন্ন গণমাধ্যম ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় লক্ষ্য করলে দেখা যায়, কেন্দ্র দখল, হামলা, ভাংচুর, সংঘর্ষ ও গুলি বিনিময়ের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামের বাঁশখালির ১৪টি ইউনিয়ন পরিষদে অনেক কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করে ভোট গ্রহণ শেষ হয়েছে। এখানে সংঘর্ষে এক শিশু নিহত, দুজন গুলিবিদ্ধ হয়েছে ও মারাত্মক আহত হয়েছে আরো ২০ জন। সেখানে সরকার সমর্থিতদের হামলায় প্রিসাইডিং অফিসারসহ আরো ২ জন গুরুতর আহত হয়েছে। গণমাধ্যমে সচিত্র প্রতিবেদনের দৃশ্য দেখে অশ্রু সংবরণ করা দুরূহ। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিজ্ঞজনদের ধারণা বর্তমান নির্বাচন কমিশনের আগ থেকেই সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন। এ ব্যাপারে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার এমরান ভূঁইয়া গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সরকার সমর্থক কয়েকজন চিহ্নিত লোক ‘জয়বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে কেন্দ্রে হামলা ও তৎসংশ্লিষ্ট প্রিসাইডিং অফিসারের কাছ হতে ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নেয়ার সাথে জড়িত
একবার কোন এক রাজার রাজ্যে বেসামালভাবে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, দুর্নীতি ও সন্ত্রাস বেড়ে গেলে রাজা অধৈর্য হয়ে রাজ্যময় ঢাকঢোল পিটিয়ে দিয়ে পাইক পেয়াদাকে বললেন, ওদেরকে ধরে এনে কঠোর শাস্তি দেয়ার জন্য। যখন পাইক পেয়াদারা তাদেরকে ধরতে যায় গিয়ে দেখে সবাই রাজার পালিত লোক। তখন রাজাকে পাইক পেয়াদারা বললো, হুজুর যে দিকেই তাকানো যায়, সবাই দেখি আপনার লোক। তা শুনে রাজা বললেন, চোখ বুজে অন্ধের মতো হেঁচকা টান দিলেই তো এমন হয়না। তারপর পাইক পেয়াদারা বললো হুজুর মৌখিক আদেশ নয়, বক্তৃতা নয়, পাতলা কাগজে আদেশ করুন। দেখবেন কত ধানে কত চাউল।

১৯৫৯ সালে মানবাধিকারের অগ্নিপুরুষ ম্যালকম এক্স এক সমাবেশে বলেছিলেন “যত পারো বুক ঝাঁঝরা করে দাও, কিন্তু ভোটাধিকার আদায় না হওয়া পর্যন্ত রাস্তা ছাড়বোনা”। গণতন্ত্রের প্রবক্তা আব্রাহাম লিংকন বলেছেন,” I am not bound to win, but I am bound to be true, I am not bound to succeed, but I am bound to live by the light that I have. I must stand with anybody that stands right and stand with him. He is right and part with him when he goes wrong.”   অর্থাৎ আমি সত্যকে বিসর্জন দিয়ে বিজয় ছিনিয়ে নিতে বাধ্য নই। আমি আমার জ্ঞানের আলো সেই লোকটির পেছনে থাকব, যতক্ষণ সে সত্যের পথে থাকে। আর যখন সে সত্য থেকে বিচ্যুৎ হবে, তখন আমিও তাকে ত্যাগ করবো। হযরত আলী (রাঃ) বলেছেন, কাফের রাষ্ট্র চালাতে পারে, কিন্তু ন্যায় বিচারহীন রাষ্ট্র চলতে পারে না। একজন বিজ্ঞজন বলেছেন, ফ্যাসিবাদী, অগণতান্ত্রিক নিষ্ঠুর শাসকেরা ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ হয়ে যায়, তাই ইতিহাসের শিক্ষা তারা নেয়না।That nobody takes lesson from history; is itself a lesson of history.   অর্থাৎ কেউ যে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়না সেটাই ইতিহাসের শিক্ষা। হযরত সোলায়মান (আ:) এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘অন্যায়কারী তার দুষ্কর্মের রশিতেই বাঁধা পড়বে এবং একদিন না একদিন তাকে কৃতকর্মের ফল ভোগ করতেই হবে।
স্বচ্ছ, শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে এত ঠেলা ধাক্কা, এত কিছুর পরও ইসি ও সিইসির প্রতি দেশের মানুষের প্রত্যাশা কম নয়। যদি এর ব্যত্যয় হয় তাহলে হয়তো কোন বেরসিক মনের দুঃখ কষ্টে গানের সুরে বলতে পারে “কোকিল ডাকিছ নারে আর- “সুখে দুঃখে জনম গেল, সুুখ হইল না আর”।

এ.কে.এম শামছুল হক রেনু : কলামিষ্ট

প্রকাশ :মে ৮, ২০১৭ ৬:০০ অপরাহ্ণ