২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১:৫৩

‘ইলা দুর্ভোগে আর কতদিন কাটাইতাম?’

নিজস্ব প্রতিবেদক:

‘অকাল পানিয়ে নিছে বরুয়া (বোরো) ক্ষেত। সাড়ে তিন মাস থাকি পানিবন্দি। কছম (শপথ) করি কইয়ার কেউ এক মুইট চাউল দিছে না। এখন ঢেউয়ে ঘরবাড়ি ভাঙ্গিয়া নেরগি। ইলা দুর্ভোগে আর কতদিন কাটাইতাম?’ এভাবেই হতাশা ব্যক্ত করলেন মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওর তীরের কুলাউড়া উপজেলার ভুকশিমইল ইউনিয়নের বড়দল গ্রামের জামাল মিয়া (৭০)। তিনি একা বাড়ি পাহারার জন্য থেকে গেছেন। স্ত্রী ৬ সন্তানকে পাঠিয়ে দিয়েছেন আত্মীয়ের বাড়িতে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায, হাকালুকি হাওর তীরবর্তী এলাকায় পানি থৈ থৈ। বিশুদ্ধ পানির জন্য চলছে হাহাকার। নলকূপগুলো বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানির খোঁজে ছুটতে হয় পার্শ্ববর্তী উঁচু বাড়িতে।

ভুকশিমইল ইউনিয়নের কাড়েরা গ্রামের শামল দাস জানান, এলাকার বেশিরভাগ মানুষের উঠানে পানি। কারো ঘরে ২-৩ ফুট পানি। পেশায় তারা মৎস্যজীবী হলেও মাছ ধরতে পারছেন না। বন্যার পানি এতই বেশি যে, জাল দিয়ে মাছ ধরা সম্ভব হচ্ছে না। গত সাড়ে ৩ মাস থেকে তারা খেয়ে না খেয়ে কোনো মতে জীবন ধারণ করছেন।

একই গ্রামের যগেশ দাশ, আব্দুল মালিক, তজমুল আলী ও প্রনতি দাস জানান, ত্রাণ চাইতে গেলে মেম্বার চেয়ারম্যানরা উল্টো ধমক দেন। ঘরে চাল নেই, চুলা জ্বলে না।

হাওর তীরে এখনও ৫০ ভাগ মানুষের কাছে সরকারি ত্রাণ সহায়তা পৌঁছায়নি। শুধু তাই নয়; গবাদিপশু গরু ছাগল নিয়েও বিপাকে রয়েছেন অনেকে। সাড়ে ৩ মাস থেকে বন্যা হলেও হাওরে কোনো প্রকার জলজ ঘাস না থাকায়, গো-খাদ্য সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করেছে।

হাকালুকি হাওর পাড়ে মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া জুড়ী ও বড়লেখা এই ৩ উপজেলায় অকাল বন্যায় বোরো ফসল তলিয়ে যাওয়া ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য ১৩টি ইউনিয়নে মে মাস থেকে ওএমএস কার্যক্রম চালু হয়। ১ জুলাই থেকে হঠাৎ করে চাল বিক্রি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন বানভাসী মানুষ।

ওএমএস ডিলার আজমল আলী জানান, ১ জুলাই থেকে চাল বিক্রি বন্ধ করে দেওয়ায় প্রতিদিন ৩-৪শ’ লোক ফেরত যাচ্ছেন। কুলাউড়া উপজেলার ৭টি ইউনিয়নে ওএমএস কার্যক্রম চালু ছিল। সেটি বন্ধ হওয়ায় মাসে বন্যাদুর্গত ৪২ হাজার পরিবার ওএমএস’র চাল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

ভুকশিমইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আজিজুর রহমান মনির জানান, ওএমএস চালু থাকলে মানুষের মাঝে এত হাহাকার থাকতো না। তাছাড়া ত্রাণ হিসেবে চালের পরিবর্তে গম দেওয়ায় মানুষ ঝামেলায় পড়েছে। ভয়াবহ বন্যায় মানুষের উঠানে পানি। গম শুকিয়ে সেগুলো আবার ভাঙানোর একটা বাড়তি যন্ত্রণায় পড়েছে বানভাসী মানুষ।

সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. গোলাম রাব্বি জানান, কুলাউড়ায় ৮টি আশ্রয় কেন্দ্রে বর্তমানে ১৭৩টি পরিবার রয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে সার্বক্ষণিক ত্রাণ সরবরাহ করা হচ্ছে।

ওএমএস প্রসঙ্গে তিনি জানান, ওএমএস চালু করার জন্য আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর চিঠি পাঠিয়েছি। শুধু কুলাউড়ায় নয় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে হাকালুকি হাওর তীরের জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলায়।

হাওর তীরের বন্যাকবলিত এলাকার শতভাগ মানুষকে প্রকৃতিকার্য (প্রসাব পায়খানা) সম্পন্ন করতে হয় বানের জলে। ফলে হাওর এলাকার বন্যার পানি ভয়াবহ দূষণের আশঙ্কা রয়েছে।

বড়লেখা উপজেলার সুজানগর ইউনিয়নের বড়তল গ্রামের ইনাম উদ্দিন ইনই (৬৭) নামে এক বৃদ্ধ রোববার মারা গেলে হাঁটু পানিতেই তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এলাকার কবরস্থান বন্যাকবলিত হওয়ায় তাকে পার্শ্ববর্তী চিন্তাপুর গ্রামে বন্যার পানিতে অর্ধনিমজ্জিত কবরস্থানে দাফন করা হয়।

জুড়ী উপজেলার দুটি আশ্রয় কেন্দ্রে ২৫টি পরিবার রয়েছে। এরমধ্যে শাহাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্রে রয়েছে ১০টি পরিবার। আশ্রয় কেন্দ্রের ২য় তলায় অবস্থান করছেন আশ্রিত মানুষ।

দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ

প্রকাশ :জুলাই ৪, ২০১৭ ১:৩৩ অপরাহ্ণ