নিজস্ব প্রতিবেদক:
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সদস্যভুক্ত কারখানার ১৫৫ শ্রমিকের মৃত্যু দাবির টাকা পরিশোধ না করে নানা টালবাহানা করছে পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। দুই বছর ধরে বীমা দাবির টাকা আদায়ে বীমা কোম্পানিটিতে একাধিকবার ধর্ণা দিয়েছে বিকেএমইএ। কিন্তু তাতে কোনো কাজ না হওয়ায় সম্প্রতি বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)- এর বিরোধ নিষ্পত্তি কমিটির দারস্থ হয়েছে বিকেএমইএ।
শ্রমিকদের বীমা দাবির টাকা আদায়ে সংগঠনটি পদ্মা ইসলামী লাইফের বিরুদ্ধে বিরোধ নিষ্পত্তি কমিটিতে দুই ধাপে ১৫৫টি মামলা করেছে। মামলায় প্রত্যেক শ্রমিকের গ্রুপ বীমা দাবি বাবদ দুই লাখ টাকা পরিশোধসহ বিলম্বিত সময়ের জন্য ব্যাংক রেটের ওপর অতিরিক্ত ৫ শতাংশ হারে মাসিক ভিত্তিতে সুদ পরিশোধের আদেশ প্রার্থনা করা হয়েছে।
একই সঙ্গে মামলা পরিচালনার খরচ এবং মৃত শ্রমিকের মৃত্যু দাবির টাকা না পাওয়ায় তার পরিবারের সদস্যদের দুঃখ-কষ্টের ক্ষতিপূরণ পরিশোধেও আদেশ প্রার্থনা করেছেন মামলার বাদী বিকেএমইএ`র জয়েন্ট সেক্রেটারি (ফায়ার অ্যান্ড আর্বিট্রেশন) মোহাম্মদ মানিক মিয়া।
বিকেএমইএ’র অভিযোগ, দাবি উত্থাপন করা হলেই নানা ধরনের অবান্তর, অযৌক্তিক ও বেআইনি প্রশ্ন তুলে এবং এর ব্যাখ্যা চেয়ে সংশ্লিষ্ট গ্রাহককে হয়রানি করছে পদ্মা ইসলামী লাইফ। দাবি নিষ্পত্তি না করে অসৎ উদ্দেশ্যে ঝুলিয়ে রেখে গ্রাহকের প্রাপ্য টাকা না দেয়ার পাঁয়তারা করছে। অথচ মৃত শ্রমিকের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে আর্থিকভাবে সুবিধা দিতেই গ্রুপ বীমার এ চুক্তি করা হয়। বীমা কোম্পানিটির অসহযোগিতা ও বেআইনি কর্মকাণ্ডের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার এখনও কোনো টাকা পায়নি।
অপরদিকে, পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কর্তৃপক্ষ বলছে, বিকেএমইএ যেসব মৃত শ্রমিকের বীমা দাবির টাকা চাচ্ছে তা সঠিক না। ওইসব শ্রমিক বীমা আইন অনুযায়ী বীমা দাবির টাকা পাওয়ার যোগ্য না। যে কারণে বীমা দাবির টাকা পরিশোধ করা হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ১১ এপ্রিল পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সঙ্গে বীমা চুক্তির মাধ্যমে বিকেএমইএ’র সদস্যভুক্ত সকল ফ্যাক্টরির কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকদের জীবন গ্রুপ বীমার আওতাভুক্ত করা হয়, যা ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কার্যকর। এরপর ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি আরেকটি চুক্তি করা হয়, যা ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কার্যকর।
উভয় বীমা চুক্তির শর্ত অনুসারে, বিকেএমইএ’র প্রতিটি সদস্য কারখানার জন্য বছরে সর্বোচ্চ ২০ জন শ্রমিকের মৃত্যু দাবি পরিশোধযোগ্য। এক্ষেত্রে যেকোনো সদস্যের যেকোনো প্রকার মৃত্যুতে দুই লাখ টাকা বীমা দাবি পরিশোধ করা হবে বলে চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়। দুর্ঘটনার কারণে পঙ্গুত্ব বরণ করলেও একই সুবিধা প্রদান করা হবে। তবে ঘোষিত বা অঘোষিত যুদ্ধ ও আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুকে বীমার আওতার বাইরে রাখা হয়।
যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিক বিকেএমইএ’র সদস্যভুক্ত নিটওয়ার ফ্যাক্টরির অধীনে পূর্ণকালীন চাকরিতে নিয়োজিত, সুস্থ এবং যাদের বয়স পরবর্তী জন্মদিনে ৬০ বছর উত্তীর্ণ হবে কেবল তাদের জীবন এ চুক্তিনামার আওতাভুক্ত। তবে বয়স ৬০ বছর পূর্ণ হওয়ার পর কোনো সদস্য চুক্তিনামার আওতায় আসবে না বলে বীমা চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়।
২০১৫ সালের বীমা চুক্তিতে প্রতি সদস্যের বীমাকৃত অর্থের হাজারপ্রতি বার্ষিক প্রিমিয়াম হার নির্ধারণ করা হয় ৮ টাকা ৭৫ পয়সা এবং প্রতি ইউনিটের বার্ষিক প্রিমিয়াম ৩৫ হাজার টাকা। এর আগে, ২০১৪ সালের চুক্তিতে বীমাকৃত অর্থের প্রতি হাজার টাকার জন্য বার্ষিক প্রিমিয়াম নির্ধারণ করা হয় ৬ টাকা ২৫ পয়সা হারে। এক্ষেত্রে প্রতি ফ্যাক্টরির জন্য বার্ষিক প্রিমিয়াম নির্ধারিত হয় ২৫ হাজার টাকা। কোনো ফ্যাক্টরির সদস্যদের তালিকা সরবরাহের পর প্রিমিয়াম পরিশোধের প্রক্রিয়ার জন্য বিকেএমইএ-কে ২০ থেকে ২৫ দিন সময় দেয়া হয়।
বীমা চুক্তির শর্ত অনুসারে, বিকেএমইএ’র সদস্য কারখানায় চাকরিরত কোনো শ্রমিকের মৃত্যু হলে সে শ্রমিক বীমা দাবি পাবেন। এক্ষেত্রে পদ্মা ইসলামী লাইফের কাছে জমা করা সংশ্লিষ্ট কারখানার শ্রমিক তালিকায় মৃত শ্রমিকের নাম থাকা বাধ্যতামূলক। সকল মৃত্যু দাবি উত্থাপন করার পর ১৫ থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে তা পরিশোধ করা হবে বলেও চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়।
মামলার বাদী মোহাম্মদ মানিক মিয়া জানান, বিকেএমইএ’র সদস্য কারখানার শ্রমিকদের দুঃসময়ে এবং মৃত্যুর পর পোষ্যদের সামান্য সহায়তার উদ্দেশ্যে যে সরল বিশ্বাসে চুক্তির মাধ্যমে পদ্মা লাইফে বীমা পলিসি করা হয়, সে বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে বীমা কোম্পানিটি। কাজেই আমাদের ন্যায্য ও আইনসঙ্গত বীমা দাবি পেতে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের বিরোধ নিষ্পত্তি কমিটিতে অভিযোগ দাখিল করতে বাধ্য হয়েছি।
মানিক মিয়া বলেন, আমরা মনে করি পদ্মা ইসলামী লাইফের কর্মকাণ্ড বীমা আইন ২০১০ এর ৭২ ধারার ১ উপধারা এবং গ্রুপ বীমা বিষয়ে সম্পাদিত চুক্তিপত্রের ৬ দফার ‘ঘ’ উপধারার লঙ্ঘন। বীমা আইন অনুসারে এটি দণ্ডণীয় অপরাধ। এছাড়া বীমা কোম্পানিটি গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা ও বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে। যা দণ্ডবিধি ৪০৬/৪১৮/৪২০ ধারার অপরাধ।
তাই বীমা দাবি আদায়ে আইডিআরএ’র বিরোধ নিষ্পত্তি কমিটিতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ পদ্মা ইসলামী লাইফের বিরুদ্ধে ১৫৫টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। প্রতিটি মামলার মোট বীমা অংক দুই লাখ টাকা। ২ শতাংশ করে প্রতিটি মামলার ফি বাবদ চার হাজার টাকা প্রদান করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ১৫৫টি মামলার ফি একত্রে মোট ছয় লাখ ২০ হাজার টাকা একটি ব্যাংক চেকের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি কমিটিকে পরিশোধ করা হয়েছে- বলেন মানিক মিয়া।
পদ্মা ইসলামী লাইফের চেয়ারম্যান এ এফ এম ওবায়দুর রহমান এ প্রসঙ্গে জাগো নিউজকে বলেন, আইন অনুযায়ী তারা (মৃত ১৫৫ শ্রমিক) বীমা দাবি পাওয়ার যোগ্য না। যদি বীমা আইন অনুযায়ী কোনো কিছু ভায়লেট হয় তাহলে আমরা বীমা দাবির টাকা দিতে বাধ্য।
তিনি বলেন, আমাদের কাছে অহরহ ক্লেম (দাবি) আসে। গ্রাহকের বীমা দাবির টাকা পরিশোধে আমাদের যথেষ্ট সুনাম আছে। সময় মতো আমরা গ্রাহকদের বীমা দাবির টাকা পরিশোধ করি। ছোট-খাট ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলেও আমরা দাবি পরিশোধ করি।