নিজস্ব প্রতিবেদক:
গুলশান হোলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলার এক বছর পেরিয়ে গেলেও সাধারণ মানুষের অনেকের মনে দৃঢ় ছাপ রেখেছে সেই হামলার ঘটনা। কারণ ওই হামলার ফলে বাংলাদেশের মানুষ প্রথমবারের মত এই ধরনের নৃশংস হামলার কবলে পড়ে, খবরের শিরোনাম হয় বিশ্বব্যাপী।
গত এক বছরে বাংলাদেশ সরকার-জঙ্গি নির্মূলে ব্যাপক তৎপরতার চালিয়ে আসছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষের এই কর্মকাণ্ডে মানুষের মধ্যে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। ২০১৬ সালের জুলাই এর এক তারিখের মধ্যরাত থেকে শুরু করে ২ তারিখ সারাদিন দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে খবর ছিল একই বিষয় নিয়ে। গুলশানের হোলি আর্টিজান নামের রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলা।
১লা জুলাই রাতেই জঙ্গিরা ২০ জনকে হত্যা করে যাদের মধ্যে ১৭ জন ছিলেন বিদেশি নাগরিক। তিন জন বাংলাদেশি। এছাড়া সন্ত্রাসীদের হামলায় দুজন পুলিশও প্রাণ হারান। পরের দিন সকালে সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযানে ছয় জন নিহত হয়। আইএস এর পক্ষ থেকে এদের মধ্যে পাঁচজনকে তাদের ‘সৈনিক’ বলে দাবি করে, হামলার দায় নেয় তারা। ঘটনার এক বছর পর আমি গিয়েছিলাম, এলাকাটি দেখতে। ভবনটি আগের মতোই আছে। মূল ফটকে তালাবদ্ধ। আশেপাশের বাড়িগুলোর অনেকগুলোর মূল ফটকে টু-লেট লেখা। একসময়কার জমজমাট রাস্তা এখন অনেকটায় থমথমে ভাব ধরে আছে। অনেক বিল্ডিংয়ে বিদেশি নাগরিক যারা ছিলেন তারা ঘটনার পর পরে চলে গেছেন, অনেক ফ্ল্যাট খালি পরে আছে যেগুলোতে এখন কেউ থাকেন না। হোলি আর্টিজানের হামলার এক বছর পর মানুষের মনে এর প্রভাব পরেছে?
কথা বলেছিলাম সাবেক এই রেস্টুরেন্টটির একেবারে পাশের ভবনের বাসিন্দা তরুন গোমেজের সাথে। তিনি বারো বছর ধরে এই ভবনে থাকেন। মি. গোমেজ বলছিলেন “আইএসের নাম শুনেছি টিভিতে, রেডিওতে কিন্তু সেই আইএস আমার বাড়ির পাশে এসে হামলা করবে এটা কল্পনাও করিনি । জুলাইতে হামলা হয় আগস্টেই আমাদের এলাকা থেকে সব বিদেশিরা বাসা ছেড়ে দেয়। এখন এই এলাকায় কোন বিদেশি থাকে না”
কূটনৈতিক পাড়া হিসেবে পরিচিত ঢাকা গুলশানের এই এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা সব সময় অন্য স্থানগুলোর চেয়ে বেশি। তার মধ্যেও যেহেতু এমন হামলা হয়েছে সেটা মানুষের মনে কঠিন একটা ভয়ের ক্ষত তৈরি করেছে।
সাদেকুল ইসলাম একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। তিনি বলছিলেন “একমাস অফিসে যাইনি, অফিস থেকে বললো বাসায় বসে কাজ করেন”। অর্ঘ ঘোষ নামে ঢাকার আরেক বাসিন্দা বলছিলেন এক বছর পেরিয়ে গেল্ওে পরিবার নিয়ে কোথাও বের হতে গেলে এখনো শঙ্কা কাজ করে মনে।
মি. ঘোষ বলছিলেন “এরপর পরিবার নিয়ে আমি কোনো স্থানে যেতে ভয় পাই। আমার সাথে আমার পরিবারের মানুষের ক্ষতি হবে সেটা মেনে নেয়া বিরাট কঠিন”।
এই ঘটনার পর সরকারের তরফ থেকে ব্যাপক তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ভাড়াটিয়াদের সম্পর্কে পূর্নাঙ্গ তথ্য সংগ্রহ, নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকা করা এবং জঙ্গি সন্দেহে দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করা। এসব ব্যবস্থায় নিরাপত্তা নিয়ে কতটা আশ্বস্ত হতে পারছে মানুষ?
ঢাকার সিদ্ধেশ্বরীতে কথা হচ্ছিল স্বস্তিকা ভট্টাচার্যের সঙ্গে। তিনি একেবারেই আশ্বস্ত হচ্ছেন না সরকারের সাম্প্রতিক জঙ্গি বিরোধী কর্মকাণ্ডে। আবার অনেকেই মনে করছেন জঙ্গি দমন অভিযান বিষয়ে মানুষের মনে এক ধরনের অস্বচ্ছ ধারণা রয়ে যাচ্ছে প্রত্যেকবার। তাই সেটাও একটা নতুন বিড়ম্বনা বলে মনে করছেন কেউ কেউ। একজন বলছিলেন “কোনো কোনো ঘটনা আছে সঠিক কোন তথ্য ছাড়াই একজনকে ধরা হচ্ছে। এরপর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে কী পাওয়া যাচ্ছে বা কেন তাকে ধরা হলো পরিস্কার করে কিছু আমরা জানতে পারছি না, যেটা নাগরিক হিসেবে ভালো উপলব্ধি দিচ্ছে না”।
আরেকজন বলছিলেন “বিষয়টা এমন দাড়ায় যদি আমার প্রতি কারো ক্ষোভ থাকে তাহলে সহজে ফাঁসিয়ে দেয়া যাবে এখন। মনে হচ্ছে সরকারের এই কাজের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে”। তবে অর্ঘ ঘোষ বলছিলেন সম্প্রতি আতিয়া মহলসহ বেশ কয়েকটি সন্দেহভাজন জঙ্গি আস্তানায় নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান সাধারণ মানুষের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি এনে দিয়েছে। গুলশান হামলা বাংলাদেশের ইতিহাসে জঙ্গি হামলার ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। যার সাথে সম্ভবত দেশের কেউ পরিচিত ছিলো না।
তাই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার যে ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে সেসব মানুষকে পুরোপুরি স্বস্তি দিতে আরো কিছু সময় লাগবে বলে প্রতিয়মান হচ্ছে কারণ এক বছর পর এখনো অনেকের মনকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে ভয়াল সেই রাতের অভিজ্ঞতা।
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ