ইট-পাথরের এই ব্যস্ত শহরে ক্লান্তিকর নাগরিক জীবনের যখন দুর্বিষহ অবস্থা ঠিক এমনি সময় রাজধানীর হাতিরঝিল হয়ে উঠেছে মনোরম এক বিনোদন কেন্দ্র। দিনে কিংবা রাতে যে কেউই ঘুরে আসতে পারেন হাতিরঝিলে।
ব্রিটিশ রাজার ধারাবাহিকতায় ভাওয়ালের রাজাদের পোষা হাতি রাখা হতো পিলখানায়। সেই সময় গোসল করার জন্য এসব হাতি ঝিলে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করত এখনকার এলিফ্যান্ট রোড, হাতিরপুল এলাকা। হাতিদের আনাগোনার কারণেই এলাকার নামের সাথে ‘হাতি’ শব্দটি যুক্ত হয়ে গেছে। আর হাতি গোসল করানোর কারণে ঝিলের নাম হয় হাতিরঝিল।
২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধন করা এই প্রকল্পটি এখন রাজধানীর মানুষের অন্যতম বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। জমি দখল রোধসহ বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, জলাবদ্ধতা ও বন্যা প্রতিরোধ, ময়লা পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন, রাজধানীর যানজট নিরসন এবং শ্রীবৃদ্ধি করতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ‘স্পেশাল ওয়ার্কস অরগানাইজেশন’র (এসডব্লিউও) তত্ত্বাবধায়নে পাঁচ বছর কাজ করার পর হাতিরঝিলকে গড়ে তোলা হয় বিনোদনের স্থান হিসেবে।
হাতিরঝিলে নৌকা ভ্রমণ
যান্ত্রিক ঢাকার মাঝে যেন এক অন্য ঢাকা হাতিরঝিল। একপাশে সবুজ, অন্য দিকে হাতিরঝিলের টলটলে পানি। সেই টলটলে পানির বুকে ছুটে যাচ্ছে যাত্রীবাহী ওয়াটারবাস। এটি যেমন দিচ্ছে মনোরম এক ভ্রমণের অভিজ্ঞতা, তেমনি যানজটহীন গুলশান থেকে কাওরান বাজারের দূরত্ব অতিক্রম করা যাচ্ছে সহজে। এখন ৫টি ওয়াটারবাস চলছে। এক একটির যাত্রী ধারণ ক্ষমতা ৪৫ জন। নিয়মিত যাত্রীদের সাথে প্রতিদিন বেড়াতে আসে ট্যুরিস্ট।
হাতিরঝিল লেকে ওয়াটার ট্যাক্সি সার্ভিস সকাল ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চলে। ওয়াটার ট্যাক্সিতে একসাথে ৪৫ জন যাত্রী চড়তে পারেন। এফডিসি টার্মিনাল থেকে গুলশান টার্মিনালে যেতে সময় লাগে ২০ মিনিট। এর চেয়েও ৫ মিনিট কমে ট্যাক্সি পৌঁছে যায় রামপুরা টার্মিনালে। এফডিসি থেকে রামপুরা টার্মিনাল পর্যন্ত ২৫ টাকা ও গুলশান টার্মিনাল পর্যন্ত ৩০ টাকা টিকিটের মূল্য। ট্যাক্সির ভেতরে একটি মিনি ক্যান্টিন রয়েছে। যাত্রীরা ওখান থেকে বিস্কুট, কেক, কোমল পানীয় ও হালকা খাবার কিনে খেতে পারেন।
এ ট্যাক্সি চালুর ফলে বাড্ডা, গুলশান, রামপুরা, খিলগাঁওসহ নগরীর পূর্বাংশের মানুষ কাওরান বাজার, মগবাজার, দিলু রোড, ইস্কাটন, বাংলামোটর, তেজগাঁওয়ের যাতায়াত ব্যবস্থা আরো সহজ হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এ সার্ভিস বারিধারা লেক পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা চলছে।
হাতিরঝিলের চক্রাকার বাস সার্ভিস
হাতিরঝিলের চারপাশের মানুষের জন্য আছে চক্রাকার বাস সার্ভিস। এসব বাস ঢাকার অন্যান্য সব সাধারণ বাসের থেকে একটু আলাদা ভেতরের আসন বিন্যাসের জন্য। প্রায় ৩২-৪৬ জনের আসন ভেতরে এমনভাবে রয়েছে যাতে আসন গ্রহণকারী সবাই মুখোমুখি বসতে পারে। অনেকটা বাইরের দেশের মেট্রোরেলের আসন বিন্যাসের মতো। এই বাসের সার্ভিস চালু থাকে সকাল ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত। বাসটি যাত্রা শুরু করে কাওরান বাজারের এফডিসি থেকে এবং রামপুরা, বনশ্রী হয়ে শুরুর স্থানেই শেষ হয়।
হাতিরঝিলে সর্বমোট ৮টি স্টপেজ রয়েছে। এক স্টপেজ থেকে আরেক স্টপেজ পর্যন্ত ১০ টাকা। হাতিরঝিলের এক মাথা হতে আরেক মাথায় যাওয়ার জন্য আপনার লাগবে মাত্র ২০ টাকা। আর পুরো হাতিরঝিল ঘুরে আসতে লাগবে মাত্র ৩০ টাকা। এই বাস সার্ভিস শুধু বিনোদনের উদ্দেশে আসা মানুষদেরই নয় বরং অনেক চাকরিজীবী ও অন্যান্য পেশার মানুষদেরও জীবনযাত্রা সহজ করে দিয়েছে। সন্ধ্যার পরে বাসের জন্য উপচে পড়া মানুষের লাইন দেখা যায়।
মিউজিকের ছোঁয়ায় আলোর ফোয়ারা
খোলা আকাশের নিচে মুক্ত হাওয়ার পাশাপাশি হাতিরঝিলে সদ্য যোগ হয়েছে রঙ-বেরঙের আলোর সাথে পানির ফোয়ারা। মিউজিকের সাথে তাল মিলিয়ে নাচতে থাকে এসব ফোয়ারাগুলো। সাথে চোখ ধাঁধানো আলোর ঝলকানি। এটি দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় মিউজিক্যাল ড্যান্সিং ফাউন্টেইন। এর ফোয়ারার পানি ১০ মিটার থেকে ৮০ মিটার পর্যন্ত ওপরে উঠতে পারে। মিউজিক্যাল ড্যান্সিং ফাউন্টেইন এবং অ্যাম্পিথিয়েটারের বাড়তি বিনোদন উপভোগ করার সুযোগ মিলে বিভিন্ন উৎসবে। এ ছাড়া মাঝে মধ্যে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা এবং রাত সাড়ে ৯টায় ১৫ মিনিটের জন্য চালু করা হয় এ বর্ণিল ফোয়ারা।
১২ কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয় নির্মিত গ্রিক ও রোমান সভ্যতার আদলে অ্যাম্পিথিয়েটার ও ওয়াটার ফাউন্টেন নির্মাণ করা হয়েছে। এই অ্যাম্পিথিয়েটারে একসাথে দুই হাজার দর্শক বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারবেন। এটি দেখতে পানির ওপর পাপড়ি মেলে থাকা ফুলের মতো। এ উন্মুক্ত থিয়েটারটি রাষ্ট্রীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানের আয়োজনের পাশাপাশি নগরবাসীর সাংস্কৃতিক চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে। আর বিভিন্ন জাতীয় দিবসে বছরব্যাপী ঐতিহ্যকে তুলে ধরবে ওয়াটার ফাউন্টেন। হাতিরঝিলের আশপাশের গুলশান, পুলিশ প্লাজা, মেরুল বাড্ডা, মধুবাগ ও মহানগর প্রজেক্ট এলাকা থেকে দেখা যায় ১ হাজার ৯৮০ বর্গমিটারের এ রঙিন ফোয়ারা। হাতিরঝিলের গুলশান আড়ং ও পুলিশ প্লাজার মাঝামাঝি অংশে গোলাকার উন্মুক্ত মঞ্চ অ্যাম্পিথিয়েটার থেকেও তা উপভোগ করতে পারছেন দর্শনার্থীরা।