রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’। এক মাস সিয়াম সাধনার পর ঈদ বয়ে আনে খুশির বার্তা। ঈদুল ফিতরে মুসলিমরা মাতেন আনন্দ উৎসবে। বিশ্বের প্রায় সব দেশে, বিশেষ করে মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে নামে আনন্দের ঢল। ঘরে ঘরে, পথে পথে ছড়িয়ে পড়ে এই আনন্দ। বাহারি রঙের নতুন পোশাক পরিধানের পাশাপাশি আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে মিষ্টি খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। তবে বিভিন্ন দেশে ঈদ উদযাপনে রয়েছে নিজস্ব কিছু রীতি। সেই অনুযায়ী তারা অতিথিদের আদর-আপ্যায়ন ও অনুষ্ঠান করে থাকে।
এবার তাহলে জেনে নেয়া যাক, মুসমিল দেশগুলোতে ঈদুল ফিতর উদযাপনের ধরণ ও আনন্দ ভাগাভাগির ধরণ-
১. সৌদি আরব:
সৌদি আরবে জাঁকজমকভাবে ঈদ উদযাপিত হয়। সুন্দর করে সাজানো হয় ঘরবাড়ি। চলে ভূরিভোজ। তবে সৌদি আরবে সব অঞ্চলে ঈদের অনুষ্ঠান কিন্তু এক রকম নয়। অঞ্চল ভেদে ভিন্ন রকম হয়। তবে ঈদ উদযাপনে তাদের উদারতা ও আতিথেয়তা নজর কাড়ে। ঈদের নামাজ শেষে বাবার বাড়িতে জড়ো হয় সবাই। দুপুরে বিশেষ ভোজের আগে ছোটরা সালামির আশায় বড়দের সামনে গিয়ে ভিড় করে। এ সময় তাদের অর্থসহ বিভিন্ন জিনিস উপহার দেওয়া হয়।
এদিন, পুরুষরা ‘কান্দর’ নামে এক ধরনের সাদা পোশাক পরে। মাথায় দেয় গাহফিহ নামের এক ধরনের গোল টুপি। আর নারীরা ‘থাউব’ নামের বিশেষ এক ধরনের পোশাক পরে। ঈদের দিন অনেক দোকানি ক্রেতাদের বিভিন্ন জিনিস উপহার দিয়ে থাকেন। এমনকি অনেক সময় অচেনা শিশুদের মধ্যেও খেলনা ও বিভিন্ন ধরনের উপহার বিতরণ করা হয়। সৌদি আরবের অনেক এলাকার অবস্থাপন্ন অনেকে প্রচুর খাবার কিনে অসহায় দরিদ্র মানুষের দুয়ারে দিয়ে আসেন। আবার কম্বল বিছিয়ে সবাইকে এক সঙ্গে খাবার খেতেও দেখা যায়। যেমন: দেশটির আল কাসিম প্রদেশে ঈদের দিন সকালে সবাই বাড়ির বাইরে বিশাল কম্বল বিছিয়ে দেয়। প্রতিটি বাড়িতে রান্না করা হয় প্রচুর খাবার। এরপর সবাই যার যার খাবার নিয়ে বাইরে জড়ো হয় এবং মিলেমিশে খায়।
২. আফগানিস্তান:
এক মাস রোজা রাখার পর ঈদ এলেও এ দেশটিতে ঈদের আনন্দ শুরু হয় রমজানের শুরুতেই। কারণ এখানে রোজা মানেই একটা অন্যরকম ব্যাপার। এখানে থুত্তুড়ে বুড়ো, শিশু, গর্ভবতী মা আর রোগী ছাড়া সবাই রোজা রাখেন। দলবেঁধে পাড়া-মহল্লার মসজিদে নামাজ পড়েন। আমাদের দেশে রোজার ঈদের আনন্দ শেষ একদিনেই। কিন্তু এখানে আনন্দ চলে একটানা তিন দিন। খোলা ময়দান নয়, এখানে ঈদের নামাজ পড়ে মসজিদে। নামাজ শেষেই আনন্দ ভাগাভাগি ও কুশল জানার জন্য সবাই ছুটে যায় বন্ধু-আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে। ঈদের নতুন পোশাকে বড়দের মোহ না থাকলেও ছোটদের বঞ্চিত করে না বড়রা। রঙ-বেরঙের নতুন পোশাক দেয় ছোটদের। সবার জন্য থাকে বিশেষ ধরনের খাবারের আয়োজন।
৩. ইরাক:
দরবেশ-আউলিয়ার দেশ ইরাকে ঈদের দিন সুগন্ধি সাবান মেখে গোসল করার পর সবাই শের-খুরমা দিয়ে মিষ্টি মুখ করে। তালিকায় বাদাম, খেজুর ও অন্যান্য খাবারও থাকে। এরপর পরিষ্কার নতুন কাপড় পরে ছোট-বড় সবাই ঈদের নামাজ পড়তে মসজিদে ছোটে। ছোটরা মেতে ওঠে নিত্যনতুন খেলায়। নামাজ শেষে সবাই যার যার বাড়িতে ফিরে আসে। একে একে আসতে থাকে আগেই দাওয়াত করা পারিবারিক বন্ধু এবং প্রতিবেশীরা। সবাই মিলে আনন্দ-আড্ডা আর খাওয়া-দাওয়া করে কাটিয়ে দেয় পুরো দিন।
৪. ইরান:
শিয়া-অধ্যুষিত ইরানিদের ঈদে দান করাটা তাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে প্রতিটি মুসলিম পরিবার গরিবদের মধ্যে খাবার বিলিয়ে থাকে। ঈদুল আজহায় কোরবানির মাংস গরিবদের মাঝে বিলি করার প্রচলন থাকলেও দেশটির অনেক ধনী ঈদুল ফিতরেও ত্যাগের মহিমায় গরু বা ভেড়ার মাংস গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে থাকেন।
৫. মিসর:
মুসা (আ.) নবীর দেশ মিসর। বিশ্বের অন্যতম মুসলিম দেশ এটি। মিসরীয়রা ঘরবাড়ি রঙ করে বা সাজিয়ে, ঈদ কার্ড পাঠিয়ে এবং নতুন কাপড় কিনে ঈদুল ফিতর উদযাপনের প্রস্তুতি নেন। ঈদের সকালে পুরুষ ও ছেলেরা ঘুম থেকে উঠে মসজিদে নামাজ পড়তে যায়। মহিলা ও মেয়েরা সাধারণত বাড়িতেই থাকে, তবে কেউ কেউ মসজিদেও যায়। বহু পরিবার নীল নদের কিনারে, পার্কে বা বিভিন্ন মেলায় দিনের কিছু অংশ কাটিয়ে থাকে। বাবা-মা প্রায়ই বাচ্চাদের ক্যান্ডি আর অন্যান্য টুকটাক খাবার কিনতে সামান্য কিছু টাকা দিয়ে থাকেন। বহু পরিবার ঈদের বিশেষ খাবার হিসেবে কাহক (অক্ষরিক অর্থে কেক) নামে এক ধরনের কুকি (পিঠা) কেনে বা বানায়। এই কুকি দশম শতাব্দীর মিসরের রাজপ্রাসাদের চুল্লিতে ছিল বলে জানা যায়, সেখানে বাবুর্চিরা কুকির ভেতর সোনার মুদ্রা পুরে দিত। আজকের দিনে এগুলো খালি রেখে দেয়া যেতে পারে বা খেজুর ভর্তা, বাদাম বা টার্কিশ ডিলাইটের (জেলির মতো এক ধরনের ক্যান্ডি) পুর দেয়া হতে পারে। কাতায়েফ আরেকটি জনপ্রিয় ঈদের মিষ্টি। দিন উদযাপনে বেরোনো আত্মীয়দের সঙ্গে খাওয়ার মতো একটা চমৎকার খাবার।
৬. ইন্দোনেশিয়া:
ইন্দোনেশীয়রা ঈদুল ফিতরকে ‘লেবারান’ বলে থাকে। রমজান মাসের শেষ দিনে সন্ধ্যায় ঢোল বাজানো, নাচ, গান, নামাজ আর বয়ানের ভেতর দিয়ে উৎসব শুরু হয়ে যায়। বহু মুসলিম বাড়িঘর পরিষ্কার করে, গোসল সেরে শরীরে গোলাপ জল বা অন্য কোনো ধরনের সৌরভ ছিটিয়ে ঈদের দিন শুরু করে। অনেকে আবার পরদিন ভোরে জেগে উঠে নতুন কাপড় পরে মসজিদ বা বিশেষভাবে আয়োজিত খোলা জায়গা, যেমন মাঠ, পার্ক বা মূল সড়কে নামাজ আদায় করে। দিনের বাকি সময়টুকু পরিবারের সদস্য ও বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা করে এবং আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে খাবার বিনিময় করে কেটে যায়। নারকেল পাতার ভেতর ভাঁপে দেয়া চালের গুঁড়ার পিঠা কেতুপাত জনপ্রিয় লেবারান খাবার। বহু ইন্দোনেশীয় সকালে ঈদুল ফিতরের নামাজের পর ঘরে ফেরার পথে পড়শি বা বন্ধুদের বাড়িতে বেড়াতে যায়। প্রায়ই সংক্ষিপ্ত এইসব সফরে তাদের বিরুদ্ধে অতীতে ঘটে যাওয়া কোনো অপরাধের জন্য ক্ষমা চাওয়ার ব্যাপার জড়িত থাকে। সত্যিই আাগের বছর আহত বা কষ্ট দেয়া হয়েছিল এমন আত্মীয় ও বন্ধুর কাছে ক্ষমা চাওয়া এই ছুটির দিনের বৈশিষ্ট্য। ইন্দোনেশিয়ায় প্রচলিত লেবারান সম্ভাষণ হচ্ছে- ‘সালামাত ঈদুল ফিতরি লাহির বাতিন’। যার বাংলা ‘শুভ ঈদুল ফিতর, আমাদের সব পাপের জন্য ক্ষমা করো।’ বেশিরভাগ ইন্দোনেশীয় মুসলিম বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করে দিন শুরু করে, তারপর বয়োজ্যেষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করে। ক্ষমার আবেদনসহ বেড়ানোর এই পালা শেষ হতে কয়েক দিন লেগে যেতে পারে। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ লেবারান কাজের ভেতর রয়েছে বিভিন্ন পার্ক ও অন্যান্য জায়গায় বেড়ানো। এসব জায়গায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
৭. ওমান:
মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম মুসলিম দেশ ওমান। ওমানের মুসলিমরা রমজান মাসের শেষ ও ঈদের সূচনাকারী নতুন চাঁদ দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। ওমানিরা বহু মুসলিম দেশের মতোই তিন দিন ধরে ঈদুল ফিতর উদযাপন করে। নতুন চাঁদ ওঠার সন্ধ্যায় বহু ওমানি পর দিনের কাজকর্মের জন্য তৈরি হতে গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকে। পুরুষরা প্রায়ই ভেড়ার গোস্ত আর সাদা চালের ভর্তার একটা মিশেল আরসীয়াহ নামে এক বিশেষ ধরনের খাবার রান্নার দায়িত্ব হাতে নেয়। মহিলা ও শিশুরা পর দিন পরার জন্য নতুন পোশাক তৈরি করে এবং মেহেদিতে হাত রাঙায়। পরদিন সকালে বিভিন্ন পরিবার নতুন পোশাক পরে ফজরের নামাজ আদায় করে এবং আরসীয়াহ দিয়ে নাশতা সারে। শিশুরা পড়শি ও প্রবীণদের শুভেচ্ছা জানায় এবং বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে টাকা পায়। এরপর পুরুষ ও পরিবারের কর্তা ছেলেরা কেবল ঈদের সময় ব্যবহৃত খোলা জায়গায় বিশেষ নামাজে যোগ দিতে বেরিয়ে যায়। পরে ঈদুল ফিতরকে ক্ষমা ও বিরোধ মিটমাটের জন্য বছরের আশীর্বাদপুষ্ট সময় বলে মনে করা হয় বলে সবাই পরস্পরের সঙ্গে হাত মেলায়। এরপর পুরুষ ও ছেলেরা স্থানীয় শেখকে অনুসরণ করে এক বিরাট হলঘরে যায়, এখানে সমবেত খাবার পরিবেশন করা হয়। খাবারের ভেতর সাধারণত আরসীয়াহ, ফল, হালুয়া আর কফি থাকে। দিনের বাকি অংশ কাটাতে পরিবারগুলো বেড়ায় বা খাবার আর বাচ্চাদের খেলনা বিক্রির বাজারে যায়। ওমানিরা লোকসঙ্গীত ও নাচ আর ফাঁকা গুলি করেও ঈদ উদযাপন করে থাকে।
৮. কাতার:
কাতারে তোপধ্বনি দিয়ে বা সাইরেন বাজিয়ে রমজান মাসের শেষ ও নতুন মাস শাওয়ালের সূচনাকারী নতুন চাঁদ দেখার সংবাদ ঘোষণা করা হয়। কাতারিরা তিন দিন ধরে ঈদুল ফিতর উদযাপন করে। সাজগোজ করে ছুটির দিনটিকে স্বাগত জানাতে তৈরি হয় তারা। মহিলারা তাদের শরীর পরিষ্কার করে এবং হাত-পায়ে মেহেদি লাগায়। কাতারে এই রেওয়াজটি এত নৈমিত্তিক যে নতুন চাঁদ দেখার ব্যাপারটিকে প্রায়ই ‘মেহেদি রাত’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। মহিলারা নতুন জুতো আর প্রায়শই সোনালি বা রূপালি সুতোয় নকশা করা কাফতান পরে। পুরুষরাও নিজেদের সাজগোজের দিকে বিশেষ নজর দেয়। তারা শরীরে সুগন্ধী মাখে বা পোশাকে আতর লাগায়। ঈদের প্রথম সকাল শুরু হয় বুলালিত (সেদ্ধ ডিমে ঢাকা মিষ্টি নুডলস), ছুটির মিষ্টি রুটি আর অন্যান্য মিষ্টি খাবার দিয়ে বিশেষ নাশতা করে। বাচ্চারা ঈদের গান গায়, বাবা-মা এবং প্রবীণরা বাচ্চাদের টাকা ও খাবার দিয়ে থাকে। নামাজ ও নাশতার পর দিনের বাকি অংশ পরিবারের সঙ্গে দেখা করার ভেতর আবর্তিত হয়। মেহমানদের দারুচিনি দেয়া কফি, গোলাপজলের সুবাসঅলা চা, বাকলাভা, ফল আর অন্যান্য মিষ্টি পরিবেশন করা হয়। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব আর প্রতিবেশীরা ঘন ঘন উপহার হিসেবে মিষ্টি খাবার বিনিময় করে। দুপুরের খাবার সময় বর্ধিত পরিবারের সদস্যরা সদ্য জবাই করা ভেড়া আর ভাত খেতে কোনো প্রবীণ আত্মীয়ের বাড়িতে জড়ো হয়। প্রায়ই ২০ থেকে ৫০ জন লোকের এই বড় আকারের সমাবেশে একটা বিরাট টেবিলে খাবার রাখা হয় এবং লোকজন খাওয়ার জন্য মেঝেতে বসে। নারী-পুরুষ আলাদাভাবে বসতে পারে। রাজধানী দোহায় বিভিন্ন প্রকাশ্য স্থানে তলোয়ার যুদ্ধ ও ঢোল বাজানোর মাধ্যমে জনতাকে আমোদ জোগানো হয়। উৎসবে অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক সংযোজন হলেও আতশবাজি পোড়ানো সন্ধ্যায় দর্শকদের চমকিত ও অনন্দিত করে তোলে।
৯. তুরস্ক:
বহু মিষ্টি পরিবেশিত হয় বলে তুরস্কে রমজান পরবর্তী তিন দিনের উৎসবটি ‘সেকর বায়রামি’ বা চিনি উৎসব নামে পরিচিত। তুর্কি নারীরা প্রায়শই বিভিন্ন চিনির মিষ্টি বানাতে দীর্ঘ সময় রান্নাঘরে কাটায়। বাকলাভার মতো প্যাস্ট্রি প্রচুর পরিমাণে দেখা যায়। তেমনি ক্যান্ডি, পুডিং ও কেক। বহু তুর্কি উপহার হিসেবে মিষ্টির ছোট ছোট প্যাকেট তৈরি করে বন্ধু বা আত্মীয়দের দিয়ে থাকে। তুর্কি শিশুরা বড়দের ছুটির সম্ভাষণ জানায়, বড়দের হাতে চুমু দিয়ে তাদের কপাল পর্যন্ত উঁচু হয়ে তাদের সম্মান দেখায়। রীতি বলে যে, এভাবে সম্ভাষণ জানানো বড়রা ছোটদের বিনিময়ে টাকা দেবেন। তুর্কিরা ছুটির দিনগুলো পরিবারের সদস্য, প্রতিবেশী আর বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করে সুস্বাদু খাবার আর উপহার উপভোগ করে কাটায় বলে সেকর বায়রামির সময় বড়দের শুভেচ্ছা জানানোর বহু সুযোগ পেয়ে থাকে। একদিনেই এমনি দশ বা তারও বেশি বেড়ানোর ঘটনা ঘটতে পারে। প্রথম দিনে ঘনিষ্ঠ ও বেশি বয়স‹ আত্মীয়দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা হয়। পৌঁছানোর পর অল্প বয়সীরা প্রথমে পুরুষদের হাতে চুমু খায়। তারপর মহিলাদেরও একই কায়দায় শুভেচ্ছা জানানো হয়। মেজবান মেহমানদের কফি ও মিষ্টি পরিবেশন করে। অতিথিরা নতুন মেহমান হাজির হলেই বিদায় নেয়। কোনো কোনো এলাকায় লোকে কুস্তি দেখে দিনটি উদযাপন করে। গ্রামাঞ্চলে গ্রামবাসীরা আশপাশের এলাকা থেকে লোকজনকে আকৃষ্ট করা নাচের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
১০. বাহরাইন;
এখানকার মানুষ সবচেয়ে সুন্দর পোশাকটা পরে ঈদের দিন। ছেলে-বুড়ো সবাই সুন্দর পোশাক পরে কাছের কোনো মসজিদেই ঈদের নামাজ আদায় করে নেয়। নামাজের আগে আল্লাহু আকবর ধ্বনিতে মুখরিত করে তোলে চারপাশ। নামাজের মাঠে যাওয়ার আগেই সামর্থ্যবানরা জাকাত আদায় করে নেয়। এটা জমা রাখা হয় স্থানীয় মসজিদের ইমামের কাছে। নামাজ শুরুর আগে ইমাম সাহেব সব গরিব-মিসকিনের মধ্যে এ অর্থ সমানভাবে ভাগ করে দেন। নামাজ শেষে সবাই একে অন্যের বাড়িতে গিয়ে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করে। ছোটরা বড়দের কাছ থেকে নানা রকম উপহার পায়।
১১. তিউনিসিয়া;
তিউনিসিয়ায় তিন থেকে চার দিন ধরে ঈদ উদযাপন করা হয়। তবে সরকারি ছুটি থাকে দুই দিন। দেশটিতে ঈদ উপলক্ষে বিশেষ এক ধরনের বিস্কুট তৈরি করা হয়ে থাকে, যা আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবকে ঈদের দিন উপহার হিসেবে দেওয়া হয়। ঈদ উপলক্ষে বাদাম, চিনির সিরা ও মধু দিয়ে বাকলাভা নামের এক ধরনের পেস্ট্রি তৈরি করা হয়। এ ছাড়া তিল দিয়ে ডোনাটের মতো এক ধরনের ঐতিহ্যবাহী পিঠা তৈরি করে তিউনিসিয়ার লোকজন। এর নাম ‘কাহকা’। অন্যান্য মুসলিম দেশের মতোই ঈদের দিন সকালে নামাজ আদায়, দিনভর আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় ও খাওয়া-দাওয়া চলে। তবে ঈদের আনন্দে নতুন মাত্রা যোগ করে গান ও নাচের আসর।
১২. দক্ষিণ আফ্রিকা:
রমজান মাসের শেষ দিনের সন্ধ্যায় দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন শহরের গ্রিন পয়েন্টে শত শত মুসলিম চাঁদ দেখার জন্য জড়ো হন। সেখানে সবার হাতে থাকে ইফতারের উপকরণ। এরপর সেখানে মাগরিবের নামাজের পর আনুষ্ঠানিকভাবে চাঁদ দেখার কথা ঘোষণা করা হয়। পরদিন মসজিদে নামাজ আদায়ের মধ্য দিয়ে ঈদ উদযাপন শুরু হয়। এরপর একে অন্যের বাড়িতে গিয়ে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিমিয় করেন। উপহার আদান-প্রদানও হয়। বাড়িতে আসা অতিথিদের আপ্যায়ন করা হয় বিস্কুট, কেক, সমুচা, পাইসহ অন্যান্য খাবার দিয়ে।
১৩. ফিলিপাইন;
ফিলিপাইনে বেশির ভাগ মানুষ খ্রিস্টান। তবে অনেক মুসলিমও আছে। ঈদুল ফিতরে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। ২০০২ সালের ১৩ নভেম্বর এই আইন সই হয়। ওই বছরের ৬ ডিসেম্বর প্রথম ঈদের ছুটি ঘোষণা করা হয়। একমাত্র খ্রিস্টান দেশগুলোর মধ্যে ফিলিপাইনে প্রথম এমন আইন পাস হয়। এর পর থেকে প্রতিবছর মুসলিমরা ঈদের বাড়তি আনন্দ ভোগ করছেন। সেই সাথে দেশটিতে মুসলিম ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ দূর হতে থাকে।
১৪. চীন:
চীন বৌদ্ধ প্রধান দেশ। তবে সরকারি হিসাবে মুসমিলসহ ৫৬টি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী রয়েছে। এই গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ঈদুল ফিতর পালন করে ১০টি সম্প্রদায়। সরকারি হিসাবে ওই ১০ গোষ্ঠী মিলে মুসলিমদের সংখ্যা প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ। ঈদুল ফিতররের দিনে দেশটির নিগজিয়া ও শিনজিয়াং প্রদেশসহ কয়েকটি অঞ্চলে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। এই ছুটি এক দিন বা তিন দিন হতে পারে। মুসলিম অঞ্চলের বাইরে থাকা মুসলমানদের জন্য এ ছুটি এক দিন। শিনজিয়াং প্রদেশে হান চাইনিজ জনগোষ্ঠী ঈদ উদযাপন করে। এ সময় সরকারি সংস্থা, ব্যক্তি মালিকাধীন ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সেবাদানের অংশ হিসেবে খাসি বা গরুর গোস্ত বিতরণ করা হয়।
১৫. মালয়েশিয়া:
এশিয়ার অন্যতম মুসলমান সংখ্যা গরিষ্ঠ ধনী দেশ মালয়েশিয়া। তাই তারা ঈদ উৎসব পালন করেন জমকালো সব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। এদিন পুরুষরা পরে সংকোক, কালো টুপি, শার্ট আর প্যান্ট। ছেলে-বুড়ো সবাই ঈদগাহে নামাজ পড়ে। নামাজ শেষে একজন আরেকজনের সঙ্গে কোলাকুলি করে, বুকের সঙ্গে বুক মেলায়। ঈদের দিন মালয় মুসলমানরা ঐতিহ্য অনুযায়ী ওপেন হাউস পালন করে। এদিন যে কেউ যে কারো বাড়িতে অতিথি হয়ে আসতে পারে এবং মুখরোচক খাবার রান্না হয় ঘরে ঘরে!
১৬. ফিলিস্তিন:
ফিলিস্তিনে ঈদের বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে ভেড়ার মাংস। যাদের সামর্থ্য আছে তারা পুরো ভেড়া রোস্ট করে, আর অন্যরা মানসাফ নামে ভেড়ার মাংসের একটা ডিশ রান্না করে। ঈদের নামাজের আগে ফিতরা করা হয়। নামাজ শেষে বাসায় গিয়ে সবাই নতুন জামাকাপড় পরে ঘুরতে যায়, সেখানে তারা প্রত্যেক বাসাতেই কিছু মিষ্টি বিতরণ করে। আর প্রত্যেক বাড়িতে গিয়ে তাদের মিষ্টি খেতেই হবে। দুপুরে পরিবারের সবচেয়ে বড় সদস্যের বাসায় সবাই একত্রিত হয়ে দুপুরের খাবার খাওয়াটাও তাদের রেওয়াজ।
১৭. বাংলাদেশ:
ঈদের দিন সকালে প্রথম আনুষ্ঠানিকতা হলো নতুন জামাকাপড় পরে ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়া। ঈদের নামাজ শুধু ছেলেদের জন্য। নামাজের পর সবাই একসঙ্গে হওয়া, দেখা করা। এ সময় বাংলাদেশে ছোটরা বড়দের পা ছুঁয়ে সালাম করে এবং সালামি গ্রহণ করে। ঈদের দিনে সালামি গ্রহণ করা প্রায় সব দেশেই রীতি আছে। তবে এর ধর্মীয় কোনো বাধ্যবাধকতা বা রীতি নেই। ঈদের দিন সেমাই সবচেয়ে প্রচলিত খাবার এবং বিশেষ আরও অনেক ধরনের খাবার ধনী-গরিব সবার ঘরে তৈরি করা হয়। এ উৎসবের আরও একটি রীতি হলো আশপাশের সব বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া এবং প্রত্যেক বাড়িতেই হালকা কিছু খাওয়া। এ রীতি বাংলাদেশের সবাই মেনে থাকে।
১৮. ভারত:
প্রতিবেশী দেশ ভারতের ঈদ উৎসবেও আছে বাংলাদেশের ছোঁয়া। ঘুম থেকে উঠেই নারী-পুরুষ, শিশু সবাই গোসল করে নেয়। শিশু ও পুরুষরা নতুন পোশাক পরে, আতর-গোলাপ ও সুগন্ধি মেখে ঈদগাহে যায়। নামাজ শেষে পুরুষরা একে অন্যের বাড়ি বাড়ি ঘোরার মজা নিলেও মেয়েরা নিতে পারে একটু পরে। এর আগে তাদের ব্যস্ত থাকতে হয় মুখরোচক সব খাবার রান্নায়। খাবারের তালিকায় থাকে সেমাই, ফলমূল, মিষ্টি, বিরিয়ানি ইত্যাদি। রান্না শেষ হলেই তারা নতুন পোশাক পরে সাজতে বসে। এ বাড়ি ও বাড়ি একটু ঘরে এসে পুরুষদের বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় থাকে। সবাই এক জায়গায় হলে খেতে বসে। সব বাড়িতেই বন্ধু-বান্ধব আর প্রতিবেশীদের আনাগোনা থাকে। বাদ যায় না অন্য ধর্মের লোকও। এখানকার শিশুরাও ঈদের দিনে সেলামিও পায়।
১৯. সিঙ্গাপুর:
সিঙ্গাপুরে সুলতান মসজিদ ও আর স্ট্রিট অঞ্চলটিতে মুসলিমদের বসবাস। তাই ঈদের সময় সেখানে উৎসবের বন্যা বয়ে যায়। আঞ্চলিকভাবে ঈদকে ‘হরি রয়া পসা’ বলা হয়। ঈদের এক মাস আগে থেকেই বাড়িঘর, দোকানপাটে শুরু হয়ে যায় আলোকসজ্জা। ঈদের দিন মুসল্লিরা সবাই ঈদের জামাতে যোগ দিতে রওনা হন সুলতান মসজিদের দিকে। নতুন জামাকাপড় পরে ঈদের নামাজ শেষে তারা বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তারপর শুরু হয় ঘুরে বেড়ানোর পালা।