২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | বিকাল ৩:৪৯

ঝুঁকিতে খাদ্য নিরাপত্তা

 নিজস্ব প্রতিবেদক: চলতি মৌসুমে অকাল বন্যায় প্রায় সবকটি হাওরের বোরো ফসল তলিয়ে গেছে। অন্যদিকে সরকারি মজুদের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়া। তাছাড়া মিল মালিকদের কাছেও চালের মজুদ না থাকা। ১০ টাকা কেজির চাল বিক্রির নামে সরকার দলীয়দের হরিলুট। এর প্রভাবে চালের বাজারে লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বেড়ে যাওয়া। বর্তমান এই অবস্থায় দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে রয়েছে বলে আভাস দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তাছাড়া বাংলাদেশ সরকার ও জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য প্রোগ্রামের (ডব্লিউএফপি) এক প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে প্রতি ৪ জনে একজন খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার শিকার। সে হিসেবে ৪ কোটি মানুষ এখন পর্যন্ত পর্যাপ্ত খাদ্য থেকে বঞ্চিত। এরমধ্যে আবার ১ কোটি ১০ লাখ মানুষের খাদ্য সংকট প্রকট। যার সবচেয়ে বড় শিকার শিশুরা। সরকারি গুদামে এই মুহূর্তে আপদকালীন খাদ্য মজুদ প্রায় তলানিতে ঠেকেছে। : গত বছরের ৩০ এপ্রিল সরকারি গুদামে চাল-গমের মজুদ ছিল ১০ লাখ ২২ হাজার ৪০ টন। চলতি বছর একই দিন এই মজুদ নেমে চার লাখ ৭৭ হাজার ৯০ টনে এসেছে। যদিও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঝুঁকির বিশ্ব তালিকায় প্রথম সারিতে থাকা বাংলাদেশে কমপক্ষে ১০ লাখ টন খাদ্য মজুদ রাখা খুবই জরুরি বলে মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের। আর সেই মোতাবেক বিগত বছরগুলোতে মজুদের পরিমাণ ছিল কম-বেশি ১০ লাখ টন। রাজধানীসহ দেশের : বিভিন্ন বাজারে উঠতে শুরু করেছে বোরোর নতুন চাল। কিন্তু তারপরও চালের দাম বেড়েই চলেছে। গত বছর আগস্ট থেকে চালের দাম বাড়তে শুরু করেছিল, কিন্তু এবার তা এখনই রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। জানুয়ারিতে আমন ধানের চাল বাজারে উঠলেও বাজারের অস্থিরতা কমাতে পারেনি। এখন বোরোর চাল বাজারে আসতে শুরু করেছে। তারপরও চালের দাম কমছে না। : প্রতিসপ্তাহে বাড়ছে চালের দাম।  সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসেবে গত শুক্রবার বাজারে মানভেদে নাজিরশাইল/মিনিকেট ৫০ থেকে ৫৬ টাকা, পাইজাম/লতা ৪৬ থেকে ৫০ টাকা ও মোটাজাতের ইরি/স্বর্ণা ৪২ থেকে ৪৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়। যা গত সপ্তাহের তুলনায় কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা বেশি। এই দর গত বছরের একই সময়ের তুলনায় নাজিরশাইল/মিনিকেট ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ, পাইজাম/লতা ১৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ ও মোটা চাল ৩১ দশমিক ৮২ শতাংশ বেশি। : ১০ টাকা কেজি দরের চাল বিক্রি কর্মসূচিতে আপদকালীন মজুদ থেকে সাড়ে সাত লাখ টন চাল সরবরাহ করার কারণেই মূলত মজুদের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, ওই কর্মসূচি নেয়ার আগে ছিল না তেমন কোনো প্রস্তুতি অথবা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। আর এ কারণেই মজুদ কমার সঙ্গে সঙ্গে সেটি পূরণ করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া হাওর অঞ্চলে আগাম বন্যাও খাদ্য মজুদ কমে যাওয়ার আরেকটি কারণ বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, এমন দুর্যোগের বিষয়টি তাদের ধারণার মধ্যেই ছিল না। : উল্লেখ্য, হাওর অঞ্চলে বিভিন্ন খাদ্য সহায়তা কর্মসূচির মাধ্যমে এ পর্যন্ত সাড়ে ১৮ হাজার টনের বেশি চাল আপদকালীন মজুদ থেকে বিতরণ করা হয়েছে। : দিনাজপুরসহ দেশের উত্তরাঞ্চলেও চালের দাম বাড়তি। এ মাসের মাঝামাঝি দেশের উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলে পুরোদমে বোরো ওঠা শুরু হবে। কিন্তু ঐসব অঞ্চলেও চালের দাম চড়া। গত বছর এই সময়ে ঐসব অঞ্চলে নতুন বোরো ধানের মণ ছিল ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা, যা এবার ৮৫০ থেকে ৯০০ টাকায় উঠেছে। এদিকে অকাল বন্যায় দেশের পূর্বাঞ্চলের সবকটি হাওর তলিয়ে সেখানকার অর্ধেকের বেশি বোরো বিনষ্ট হয়ে গেছে। তাই হাওরাঞ্চল থেকে বোরো সরবরাহ নেই। দেশের অন্যতম প্রধান শস্যভান্ডার চলনবিলেও অকাল বন্যা হয়েছে। এসব কারণে চালের দাম সামনে আরো বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। : চলতি মৌসুমে অকাল বন্যায় প্রায় সবকটি হাওরের বোরো ফসল তলিয়ে গেছে। কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সিলেট বিভাগের চার জেলা হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও সিলেটে মোট চার লাখ ৭৬ হাজার ৮৩ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। এছাড়া নেত্রকোনায় ১ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর ও কিশোরগঞ্জে এক লাখ ৬৫ হাজার ৫১৫ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। সবমিলিয়ে হাওরবেষ্টিত ৬ জেলায় মোট ৮ লাখ ২৫ হাজার ৫৯৮ হেক্টর জমিতে এবার বোরোর আবাদ হয়েছিল। এরমধ্যে সিলেট বিভাগের ৪ জেলায় ২ লাখ ৫৩ হাজার ৯০৭ হেক্টর, নেত্রকোনায় ৭০ হাজার ও কিশোরগঞ্জে  ৫৭ হাজার ২৭ হেক্টর জমির বোরো ধান সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়েছে। সিলেট বিভাগে মোট ১২ ভাগ বোরো কাটা হয়েছে। বার্ষিক ৯ লক্ষাধিক টন খাদ্য উদ্বৃত্ত সিলেট অঞ্চলে এবার উদ্বৃত্ত দূরের কথা, উৎপাদিত খাদ্য দিয়ে হাওরবাসীর চাহিদা মেটানো সম্ভব নয় বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। : এদিকে দাম বাড়ায় চাল আমদানিতে সাময়িকভাবে শুল্ক তুলে দেয়ার চিন্তা-ভাবনা করছে সরকার। কারণ চলতি অর্থবছরে চাল আমদানির ওপর শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করায় চাল আমদানি কমে গেছে। ছয় বছর পর সরকার ছয় লাখ টন চাল আমদানির চিন্তাভাবনা করছে বলে খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে। : এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী গণমাধ্যমকে বলেন, মিলারদের কাছে চালের কোনো মজুদ নেই। অন্যদিকে সরকারি মজুদও তলানিতে ঠেকেছে। পরিস্থিতি এতটাই নাজুক যে, চাল আমদানির শুল্ক তুলে নেয়া হচ্ছে। আমরা শুল্ক তুলে নেয়ার বিপক্ষে হলেও মজুদ পরিস্থিতির কারণে রাজি হতে হয়েছে। : খাদ্য মজুদ ঝুঁকির বিষয়ে সাবেক সচিব আবদুল লতিফ মন্ডল গণমাধ্যমকে বলেন, বিপদের কথা চিন্তা করেই আপদকালীন মজুদ রাখা হয়। চালের সরকারি মজুদ তিন লাখের নিচে নেমে আসা কোনো ভালো খবর নয়। সরকারের উচিত যে কোনো মূল্যে চালের মজুদ ও বাজারে চালের সরবরাহ বাড়ানো। কারণ একদিকে সরকারি গুদামেও চাল নেই; অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন তাদের কাছেও চাল নেই। মজুদ যত কম হবে ততই দাম হু হু করে বাড়বে। ব্যবসায়ীরা যখন জানতে পারেন সরকারি মজুদ কম, তখন তারা ইচ্ছামত দাম বাড়াবেই। আর যদি আগাম বন্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা থাকে, তাহলে তো দাম ও মজুদ দুটোই বাড়াবে। কারণ তারা জানেন, সরকারি মজুদ পর্যাপ্ত না থাকায় ইচ্ছা করলেই সরকার ওএমএস বা অন্য কোনো কর্মসূচি চালু করতে পারবে না। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে গরিব ও সাধারণ মানুষ। : তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন পর্যাপ্ত বরাদ্দ, সচেতনতা ও জবাবদিহিতা ছাড়া, দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. বদরুল হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, হাওর এলাকায় অকাল বন্যায় ক্ষতি হলেও বোরো সংগ্রহের টার্গেট ব্যাহত হবে না। দেশে যে খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি চলছে তাতে প্রতি মাসে চাল-গম খরচ হচ্ছে মাত্র ২৫ হাজার টন। এখনও যে মজুদ রয়েছে তাতে আরও সাত-আট মাস চলবে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) থাকায় জিটুজি পদ্ধতিতে স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় চাল-গম আনা সম্ভব। ফলে বড় ধরনের দুর্যোগ হলেও তা মোকাবিলার সামর্থ্য সরকারের রয়েছে। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন নয় সরকার।
প্রকাশ :মে ৭, ২০১৭ ১২:৪৬ অপরাহ্ণ