নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশে দুর্নীতির জয় হয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান।
মজিবুর রহমান বলেন, ‘নীতি ও দুর্নীতির লড়াই উন্নয়নের পথে বড় বাধা। যেখানে নীতির জয় হয়, সেখানে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। আর দুর্নীতির জয় হলে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। আমার মনে হয় বাংলাদেশে দুর্নীতির জয় হয়েছে।’
ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকস (ডিএসসিই) ও ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) যৌথ আয়োজনে গতকাল শনিবার বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত প্রাক্-বাজেট আলোচনায় মজিবুর রহমান এসব কথা বলেন।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিস) ভারপ্রাপ্ত গবেষণা পরিচালক মাহফুজ কবীর ‘বাজেটের খাতভিত্তিক বিষয়’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
‘বাংলাদেশের শুল্ককাঠামো ও বাজেটে খাতভিত্তিক বরাদ্দ’ নামে যৌথভাবে আরেকটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ট্যারিফ কমিশনের গবেষণা কর্মকর্তা মির্জা আবুল ফজল মো. তৌহিদুর রহমান ও সুমাইয়া জাবীন। আলোচনা অবশ্য একপর্যায়ে দুর্নীতি, শিল্পায়ন, বিনিয়োগ, রপ্তানি—এসব দিকে মোড় নেয়।
দেশে আমলাতন্ত্রের অধঃপতন হচ্ছে উল্লেখ করে মজিবুর রহমান বলেন, ৪০ বছর ধরে অ্যাডহক ভিত্তিতে বাজেট করা হচ্ছে। আর এবার করা হচ্ছে কর নিয়ে বাড়াবাড়ি। অথচ যেকোনো কিছু করার আগে নীতিনির্ধারকদের মাথায় রাখা উচিত মানুষকে। রাজস্ব সংগ্রহ হবে, ব্যয় হবে—এটা একটা খেলা। খেলাটা তাঁদের জানতে হবে।
দেশে শিল্পনীতির কোনো আইনি মূল্য নেই জানিয়ে মজিবুর রহমান বলেন, এ নীতি কেউ মানে না। কেন যে সময় নষ্ট করে এসব করা হয়? শিল্পের জন্য দরকার আগে ভূমি। অথচ এ দেশের ভূমি ব্যবস্থাপনা যেকোনো দেশের চেয়ে খারাপ।
মজিবুর রহমান আরও বলেন, ‘বক্তৃতায় বলছি রপ্তানি বাড়াতে হবে, আর নীতি করছি রপ্তানি কমার।’
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক পরিচালক ও গাড়ি আমদানিকারক আবদুল হক বলেন, ‘দেশের সম্পদ পাচার হচ্ছে। দুর্নীতি কমাতে পারলে বাড়তি করের বোঝা জনগণকে বইতে হতো না।’
শিল্প করার জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ে একটা টেবিলও নেই। এ ছাড়া কোনো গবেষণা নেই, পরিকল্পনাবিদ নেই, কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন লোক নেই। ঔপনিবেশিক যুগের মতো প্রশাসনের কিছু লোক বসে আছেন সেখানে। এভাবে শিল্প হয় না।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ জোর দেন মূল্য সংযোজন করের (মূসক) আলোচনায়। বলেন, মূসক দেন এবং ভবিষ্যতেও দেবেন ভোক্তারা। অথচ ভোক্তাদের কোনো কণ্ঠস্বর নেই। কথা বলছেন মূসক সংগ্রহকারীরা। এটা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
আবদুল মজিদ বলেন, ২০১২ সালের পর থেকে কতজন অনলাইনে মূসক নিবন্ধন করেছেন? অথচ ধরেই নেওয়া হচ্ছে যে সবাই বিজ্ঞ হয়ে গেছে। উন্নত হয়ে গেছে দেশ।
ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্টস বাংলাদেশের (আইসিএবি) সাবেক সভাপতি মসিহ মালিক চৌধুরীও বলেন, ‘প্রাক্-বাজেট আলোচনা হচ্ছে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। অথচ ব্যবসায়ীরা আলোচনাটা করছেন তাঁদের স্বার্থ দেখে।’ দেশের বাজেট বাস্তবায়নের তদারকব্যবস্থা দুর্বল বলে তিনি সমালোচনা করেন।
ডিএসসিইর গভর্নিং কাউন্সিলের চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি নিয়ে আলোচনার কোনো অর্থ নেই। দরকার হচ্ছে টেকসই উন্নয়নে মনোযোগী হওয়া। আর এ জন্য প্রতিবন্ধী, উপকূলবাসী, দলিত, দ্বীপবাসী, হাওরবাসী, নারী ও কৃষিশ্রমিকদের কথা খেয়াল রাখতে হবে।
শুল্ককাঠামো নিয়ে কাজ করার দায়িত্ব ট্যারিফ কমিশনের, কিন্তু করছে এনবিআর। আবদুল মজিদ এনবিআরের চেয়ারম্যান থাকার সময়ও এটা ছিল। তবে মজিবুর রহমান ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান থাকার সময় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেও পারেননি। ট্যারিফ কমিশনের কাজ কি ট্যারিফ কমিশন করতে পারবে না?
এমন প্রশ্নের জবাবে আবদুল মজিদ বলেন, তাঁর সময়ে ট্যারিফ কমিশনের সঙ্গে সমন্বয় রেখেই চলত এনবিআর। তাই কোনো সমস্যা হতো না।
আর মজিবুর রহমান বলেন, ‘প্রশ্নটি যথার্থ। দক্ষিণ এশিয়া তো বটেই, গোটা বিশ্বেই এটা একমাত্র ঘটনা হতে পারে যে একটা সংস্থার কাজ করছে অন্য সংস্থা। সমাজে ন্যায়বিচার নিশ্চিত না থাকলে এমনই হয়। এমনকি মোটরসাইকেল কারখানা করার নীতিও শিল্প মন্ত্রণালয় নয়, এনবিআর করে দিয়েছে।’
আলোচনায় আরও অংশ নেন বাংলাদেশ ব্যাংক প্রশিক্ষণ একাডেমির সাবেক অধ্যক্ষ কে এম জামসেদ উজ জামান, ডিএসসিইর অধ্যাপক মাহবুব আলী, ইআরএফের সভাপতি সাইফ ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমান।