জেব্রা ক্রসিংয়ে রাস্তার দুই পাড়ে হলুদ-কালো-হলুদ এভাবে রাঙানো দুটি লোহার খুঁটি দাঁড়িয়ে। তার গায়ে পুশ বাটন আর ব্যবহার নির্দেশিকা আঁটা। তাতে লেখা: থামুন, বাটন চাপুন, অপেক্ষা করুন, সিগন্যাল দেখুন, হাঁটুন। অর্থাৎ এখানে রাস্তা পার হওয়ার জন্য বাটন চাপলে সিগন্যাল পয়েন্টে লাল বাতি জ্বলে উঠবে। তাতে যানবাহন থেমে গেলে পর পথচারীরা নিরাপদে সড়ক পার হবেন।
উন্নত দেশের আদলে রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুরে প্রথমবারের মতো ‘পুশ বাটন সিগন্যাল’ পদ্ধতি চালু করেছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। কিন্তু চালুর আড়াই মাসের মধ্যে এর অপমৃত্যু হয়েছে! পুশ বাটন আছে, নির্দেশিকা আছে, কিন্তু বাটন চাপলে কোনো কাজ হয় না। এটি এখন পরিণত হয়েছে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালে।
আবার এটি স্বয়ংক্রিয় কি না, সেই নির্দেশনাও নেই সিগন্যালটির পাশপাশে। এমনকি এটি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা কর্মী বা পুলিশেরও দেখা নেই। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা পুশ বাটন সিগন্যালটি এখন যেন পথচারীদের উপহাস করছে। বাটন চেপে চেপে বিভ্রান্ত হন তারা। নির্দেশমতো বাতি জ¦লে না। অন্যদিকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যে বাতি জ¦লে তাতে বিভ্রান্ত হন চালকরা। লাল বাতি জ¦লে উঠে সময়সীমা দেখালেও পরে আবার একই সময় প্রলম্বিত হয়।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে আসাদ এভিনিউয়ের গ্রিন হেরাল্ড স্কুলের সামনে গত বছর ২৪ অক্টোবর স্থাপন করা হয় ‘পুশ বাটন ট্রাফিক সিগন্যাল’। দেশে প্রথমবারের মতো এই আধুনিক সিগন্যাল চালুর এক মাস পর্যন্ত তা ব্যবহারের কোনো নির্দেশিকা সেখানে ছিল না। গত ১৮ নভেম্বর সিগন্যাল পয়েন্টের পাশপাশে পুশ বাটন ব্যবহারের নির্দেশনা দেয়া হয়। একই সঙ্গে পথচারী ও চালকদের ট্রাফিক আইন ও পুশ বাটন সম্পর্কে অবগত করতে লিফলেট বিতরণ করেন ডিএনসিসির সদ্য সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম ও নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন।
আতিকুল ইসলাম তখন জানিয়েছিলেন, ডিজিটাল পুশ বাটন ব্যবস্থাপনার জন্য করপোরেশনের পক্ষ থেকে দুই শিফটে ছয়জন, ট্রাফিক পুলিশের পক্ষ থেকে চারজন এবং স্কুলের পক্ষ থেকে দুই শিফটে চারজন কাজ করবে। তাারা পথচারীদের নিরাপদে পারাপার হতে সহযোগিতা করবেন।
কিন্তু আজ সোমবার সরেজমিনে গিয়ে এমন কোনো নজির সেখানে পাওয়া যায়নি, যা মেয়রের বক্তব্যের পক্ষে যায়। গ্রিন হেরাল্ড স্কুলের নিরাপত্তাকর্মী মাহবুব ও ধ্রুব জানান, গত ২০ ডিসেম্বর থেকে স্কুলটি বন্ধ। ফলে পুলিশ সদস্যরা মাঝেমধ্যে এসে ঢুঁ মেরে যাচ্ছেন। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে যে কর্মী নিয়োগ করা হয়েছিল এক মাস ধরে তাদের দেখা নেই। আর স্কুল বন্ধ থাকায় স্কুলের নিরাপত্তাকর্মীরা কাজ করছেন না।
পুশ বাটন পরিদর্শন ও সচেতনতা কার্যক্রমের সময় আতিকুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘নভেম্বর ও ডিসেম্বরে পুশ বাটনের ব্যবহার নিশ্চিত করতে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। জানুয়ারির ১ তারিখ থেকে পথচারী বা চালকরা সিগন্যাল না মানলে জরিমানা করা হবে।’
মেয়রের এই বক্তব্য বাস্তবায়নের আলামতও চোখে পড়েনি ওই সিগন্যাল পয়েন্ট এলাকায়। স্থানীয় লোকজন জানান, এক মাস ধরে সিগন্যালটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলছে। পথচারীরা বারবার বাটন চাপলেও তা কোনো কাজে আসছে না। বাধ্য হয়ে চলন্ত গাড়ির সামনে দিয়ে রাস্তা পারাপার হচ্ছে তারা।
মো. ইব্রাহিম নামের একজন বলেন, ‘এই বাটন পুশ করলে কাজ করে না। একা একাই চলছে। কয়েক দিন দেখলাম লোক ছিল, তারা সবাইকে সাহায্য করত। এখন তো কেউ নাই।’
বিড়ম্বনায় চালকরাও। প্রাইভেট কারের চালক নিজাম উদ্দিন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘কখন সিগন্যাল লাল হয়, কখন সবুজ হয় বুঝি না। একবার দেখি ৩০ সেকেন্ড টাইম উঠল, টাইম শেষ হলে তো সিগন্যাল সবুজ হওয়ার কথা। না, আবার ৩০ সেকেন্ড টাইম ওঠে। এটা কেমন সিস্টেম!’
পুশ বাটন পরিদর্শন ও সচেতনতা কার্যক্রমের সময় উপস্থিত ছিলেন নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চল। সিগন্যালটির বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘সিগন্যালটির ব্যবহার নিশ্চিত করতে স্কুল, সিটি করপোরেশনের লোক এবং পুলিশ থাকার কথা ছিল। চার-পাঁচ দিন আগে আমি ওই দিকে গিয়েছিলাম। তখন আমি কাউকে দেখিনি।’
সিগন্যালটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলার জন্য করা হয়নি জানিয়ে ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘আমাদের সমস্যা এখানেই, আমরা নিয়ম করি, কিন্তু সেটি রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারি না।’
সিগন্যালটির দায়িত্বে রয়েছেন উত্তর সিটির ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেলের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ফরহাদ। পুশ বাটন পদ্ধতি তার নিয়মে চলছে না, করপোরেশনের লোকও সেখানে দায়িত্ব পালন করছেন না- এ ব্যাপারে কিছুই তার জানা নেই বলে জানান তিনি। ঢাকা টাইমসের কাছ থেকে তিনি প্রথম অবগত হলেন বিষয়টি।
মো. ফরহাদ জানান, এ ব্যাপারে সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে দ্রুত। একই সঙ্গে পুলিশের পক্ষ থেকে জরিমানা নিশ্চিতের বিষয়টির প্রতি নজর দেয়া হবে বলে জানান তিনি।