২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সকাল ৬:৩১

মধ্যরাতের টকশো থেকে গভীর রাতের সিএনজি

রাজধানীতে গভীর রাতে রাস্তায় তল্লাশির নামে এক তরুণীকে হেনস্তার ভিডিও ভাইরালের ঘটনায় জড়িত দুই পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। গত সোমবার রাত ২টার দিকে শহরের একটি রাস্তায় পুলিশের তল্লাশি চৌকিতে সিএনজিচালিত অটোরিকশার যাত্রী এক তরুণীকে হেনস্তা করেন কয়েকজন পুলিশ সদস্য।

তরুণীর সঙ্গে পুলিশের বাকবিতণ্ডার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর পুলিশ বিভাগীয় ব্যবস্থা হিসেবে অভিযুক্তদের সাময়িক বরখাস্ত করেছে। পুলিশ কমিশনার বলেছেন আগের চেয়ে চেকপোস্টে পুলিশের ব্যবহার উন্নত হয়েছে, যার কারণে অভিযোগ অনেক কমে এসেছে।

মধ্যরাতের টেলিভিশন টকশো থেকে গভীর রাতের সিএনজি – উভয় ঘটনায় আমরা দেখলাম, একটা পক্ষ কি ভয়ংকরভাবে হয়রানির শিকার দুই নারীকে কদর্য ভাষায় আক্রমণ করছে। এদের মধ্যে সমাজ বিরোধী চক্র, প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক চক্র যেমন আছে, তেমনি আছে লেখপড়া জানা কিছু সুশীল চক্রও

বিভাগীয় ব্যবস্থা নিয়ে জনমনে সংশয় আছে। কারণ মানুষের ধারণা এই সাময়িক বরখাস্ত বা ক্লোজ্ড করা ছাড়া বড় কোন শাস্তি আসলে হয় না অভিযুক্তদের। তাই কি ধরনের শাস্তি পাচ্ছেন কোন অপরাধের জন্য তা জনগণের সামনে পরিষ্কার করাই বোধ করি স্বচ্ছতা। ভয় আরও যে, বিভাগীয় ব্যবস্থার নামে সেই মেয়েটিকে আবার কোন ট্রমার ভেতর দিয়ে যেতে হয় কিনা।

পুলিশ কমিশনার যখন বলেন, অভিযোগ কমে আসছে তখন আশ্বস্ত হতে হয়। ধন্যবাদ জানাই যে, সামাজিক মাধ্যমে ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার সাথে সাথে পুলিশ কর্তৃপক্ষ সাড়া দিয়েছেন। কিন্তু স্বস্তি পাইনা যখন দেখি পুলিশ সদস্য বলছেন, কোনো ভদ্র ঘরের মেয়ে রাত আড়াইটায় রাস্তায় থাকে না। ভদ্র ঘরের মেয়ে কখন ঘরে থাকবে, কখন বাইরে থাকবে সেই সনদ যদি পুলিশ দিতে শুরু করেন, তাহলে নারীতো বটেই, সাধারণ মানুষ কার কাছে আশ্রয় চাইবে? ঘটনাটি এমন এক সময়ে ঘটেছে, যখন সাবেক উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ধিক্কার গ্রহণ করে কারাগারে আছেন একজন নারী সাংবাদিককে টেলিভিশন টকশোতে চরিত্রহীন বলে।

জনসাধারণের দায়বদ্ধতা, নীতি-নৈতিকতা এবং কর্তব্যের প্রতি বিন্দুমাত্র নিষ্ঠা থাকলে পুলিশ এভাবে কথা বলতে পারেনা। তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষার যে প্রশিক্ষণ হয় এই বাহিনীর, তার সাথে ধারণা করছি নারী ও নাগরিকের প্রতি কি ধরনের আচরণ করা হবে সেই মনস্তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণও তাদের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে।

সনাতন ভাবনাচিন্তা হলো, নারীর আচরণই ধর্ষকদের আহ্বান জানায়। মৌলবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল এবং মানবতাবিরোধী চক্র এমনভাবেই কথা বলে। কিন্তু যাদের কাছে ভরসা চাওয়া, তারা নিশ্চয়ই এমনটা ভাবতে পারেন না।

নারীর প্রতি সহিংসতা এমন এক অপরাধ যা নিয়ে কথা বলতে গেলে নারীর পোশাক, চরিত্র, আচরণ এবং ঘোরাফেরা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। অন্য কোন অপরাধে এসব প্রশ্ন উঠেনা। এসব প্রশ্ন তুলে প্রকারান্তরে নারীর উপর আক্রমণের দায় আবার নারীর উপরই চাপিয়ে দেয়া হয়।

মধ্যরাতের টেলিভিশন টকশো থেকে গভীর রাতের সিএনজি – উভয় ঘটনায় আমরা দেখলাম, একটা পক্ষ কি ভয়ংকরভাবে হয়রানির শিকার দুই নারীকে কদর্য ভাষায় আক্রমণ করছে। এদের মধ্যে সমাজ বিরোধী চক্র, প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক চক্র যেমন আছে, তেমনি আছে লেখপড়া জানা কিছু সুশীল চক্রও।

সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টি কিংবা সিএনজির সেই অসাধারণ সাহসী মেয়েটি শুধু নন, আমরা দেখছি প্রায়ই অগ্রসরমান নারীর বিরুদ্ধে সংগঠিত হিংসা ও আক্রমণ চলতে থাকে। দুই একটি ঘটনার পর কিছু আলোচনা হয়, আলোড়ন হয়, অপমানিত আমরা কিছু কথা লিখি ও বলি- তারপর সব ভুলে যাই।

আমাদের আইন অনেক আছে, আইন প্রণয়নের প্রতি আগ্রহও অনেক। কিন্তু অপরাধীর মনঃস্থিতি বিশ্লেষণে মনযোগ কম আমাদের। বিভাগীয় ব্যবস্থা একটি পন্থা মাত্র, কিন্তু সেই পুলিশ সদস্যদের মনের শুদ্ধতা আনার প্রক্রিয়া নিয়ে ভাবতে পারেন পুলিশ প্রশাসন। সেটাই বেশি কাজে দেবে বলে মনে করছি।

আর পুরো ব্যবস্থাই যে, আসলে রাজনৈতিক ভণ্ডামির কারণে ঘটছে সেকথাও আমাদের জানা। রাজনীতি আমাদের এমন এক সমাজ ব্যবস্থা উপহার দিয়েছে এবং দিয়ে চলেছে যে, সেখানে একমাত্র পুষ্টিকর প্রবৃদ্ধি হচ্ছে মৌলবাদের। সব দলই এদের কাছে টানে, প্রশ্রয় দেয়।

ফলে আমরা ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড চাই, নারী নির্যাতনকারীর উপযুক্ত শাস্তি চাই বলে চিৎকার করি, কিন্তু সেই নারীকে স্বাভাবিক জীবন ও জীবিকায় বঞ্চিত দেখলে আমাদের বিকার হয় না। মানুষের হৃদয় পরিবর্তন হোক এমন বাসনাই করতে পারি। বিশেষ করে রাজনীতিক, পুলিশ ও প্রশাসনের মানুষদের। নারীর প্রতি অশালীন উক্তি করে কেউ যেন চাকরিতে আরও পদস্থ হতে না পারেন। নারীর প্রতি হিংসাকে ইন্ধন জুগিয়েও নেতা বৃহত্তর নেতায় যেন পরিণত হতে না পারেন।

প্রকাশ :অক্টোবর ২৭, ২০১৮ ৩:৫২ অপরাহ্ণ