সিলেট প্রতিনিধি :
ধর্মের নাম ভাঙিয়ে আধ্যাত্বিক চিকিৎসা দিচ্ছেন মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের শিপ্রা রানী দেব (৪৫)। নিজেকে তিনি হিন্দু ধর্মীয় দেবী ‘বিপদনাশিনী’ দাবী করেন। তার এই দাবিতে অনেক সহজ সরল মানুষ বিশেষ করে মহিলারা বিভ্রান্ত হচ্ছেন। হারাচ্ছেন মূল্যবান জীবন এবং টাকা পয়সা। ধর্মের নামে প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণা করে আসছে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের এই নারী।
নিজ এলাকা এবং আশেপাশে মানুষদের মধ্যে শিপ্রা রানী দেব এবং তার সহযোগী চক্র কৌশলে প্রচার করতে থাকে শিপ্রা রানী দেব হিন্দু ধর্মীয় বিপদনাশিনী দেবীর আর্শীবাদ পেয়েছেন, তার কাছে গেলে যেকোনো বিপদ থেকে তিনি রক্ষা করতে পারবেন।
এলাকায় বিপদনাশিনী আশ্রয় করেছেন এই ব্যাপারটা খুব ভালো করেই ছড়িয়ে দিয়েছে তার চক্রের সদস্যরা। এমন খবর ছড়িয়ে পরায় দূর-দুরান্তের সহজ সরল মানুষগুলো নিজেদের সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে তার কাছে হাজির হয়। একবার যে তার কাছে যায়, সে আর কখনও শিপ্রা রানীর জাল থেকে বের হতে পারে না। বিভিন্ন কৌশলে এবং ধর্মকে ব্যবহার করে সে তার জালে আটকে রাখে। এরই মধ্যে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে চাঁদা তুলে মন্দির তৈরি করেছে কথিত বিপদনাশিনী নামধারী শিপ্রা রানী দেব। তার তৈরি মন্দির এখন প্রতারণার আস্তানা।
প্রতিদিন তার কাছে আসছেন নতুন নতুন মানুষ, নতুন নতুন সব সমস্যা নিয়ে। তিনি স্বল্প বসনা হয়ে তার বাড়িতে উপস্থিত লোকদের সামনে অবলিলায় নাচতে থাকেন। যখন নাচতে থাকেন তখন তার চক্রের লোকেরা উপস্থিত সহজ সরল মানুষদেরকে বলেন এই যে বিপদনাশিনী তার উপর আশ্রয় গ্রহণ করেছে। তখন উপস্থিত সহজ সরল মানুষ তার কাছে বিভিন্ন ধরনের সাহায্য চায় প্রতিকারের আশায় সেও সব কিছুর সমাধানের আশ্বাস দেয় এবং ভাব-ভঙ্গি সবকিছুতেই নিজেকে তখন এই পৃথিবীর বাইরের কেউ হিসেবে প্রকাশ করে কৌশলে।
শিপ্রা রানীর অপচিকিৎসার তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ২০ ফেব্রুয়ারি কমলগঞ্জ উপজেলার গোপালনগর এলাকার ৪ বছর বয়সী বৃদ্ধিরাণী ঘোষ নামের এক মেয়ে মারা গেছে। মেয়েটির বাবা বিশ্বজিৎ ঘোষ জাগো নিউজকে জানান, শিপ্রা রানীর কারণে তার মেয়ের লাশ কাঁধে নিতে হয়েছে।তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমার ধর্মীয় আবেগকে পুঁজি করে তারা আমার মেয়েকে মেরেছে। চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা দেয়া হয়েছে।
তিনি জানান, অনেক দিন যাবৎ অসুস্থ মেয়ের চিকিৎসা করিয়েছেন। বৃদ্ধি রাণী ঘোষ চোখের রোগে ভুগছিল। মৌলভীবাজার বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতাল এবং জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ডাক্তার খায়ের আহমেদ চৌধুরী তার চিকিৎসা করেছিলেন। ডাক্তার রোগীর চোখের অস্ত্রোপচারের জন্য মতামত দেন এবং ইস্পাহানি ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে রেফার্ড করেন।কিন্তু বৃদ্ধি বাবা এই চক্রের অন্যতম সদস্য শিপ্রার কথিত পালক পুত্র শ্রীকান্তের কাছে জানতে পারেন আধ্যাত্বিক চিকিৎসায় বিপদনাশীনি তার মেয়েকে সুস্থ করে দেবেন।
কথা শুনে মেয়েকে সুস্থ করার ইচ্ছায় শ্রীমঙ্গলস্থ শিপ্রা রানী ঘোষের দ্বারস্থ হন। এতে কথিত ‘বিপদনাশীনি’ শিপ্রা রানী ও তার ছেলেসহ চক্রের লোকজন তাকে ৩ মাসের মধ্যে মেয়ের আরোগ্য হবে এরুপ আশ্বাস দেন। ছোট্ট মেয়েকে চিকিৎসার বিধি অনুযায়ী শিপ্রা রানীর আশ্রমে রেখে আসা হয়। কিছুদিন পর মেয়ের কোনো উন্নতি না হওয়ায়, উন্নত ও সুচিকিৎসার জন্য নিতে চাইলে ধর্মীয় বিধি -নিষেধ আছে ও দেবী আশ্রয় করেছেন, তার আরোগ্য হওয়া শুরু হয়েছে ইত্যাদি বলে কালক্ষেপণ করেন। বিভিন্ন অজুহাতে এরই মধ্যে চিকিৎসার নাম করে এক লাখ ৬৫ হাজার টাকা নিয়েছে শিপ্রা। এরই মধ্যে গত ২০ ফেব্রুয়ারি শিশুটির মৃত্যু হয়।
অন্য আরেকটি অভিযোগ সর্ম্পকে জানা যায়, শিপ্রা রানীর অপচিকিৎসার শিকার হয়ে এরই মধ্যে রাশনা বেগম নামে একজন সিলেটে চিকিৎসা নিচ্ছেন। চিকিৎসার জন্য শিপ্রা রানীর কাছে এলে রাশনা বেগমকে আধ্যাত্বিক চিকিৎসার নামে আঘাত করে এবং এক পর্যায়ে রোগীর রক্তস্রাব হতে থাকে। এ পর্যায়ে তিনি শিপ্রা রানীর বিরুদ্ধে শ্রীমঙ্গল থানায় অভিযোগ দায়ের করেন।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিপ্রা রানী বীমা কোম্পানিতে চাকরি করতেন। মন্দির নির্মাণের পর চাকরি ছেড়ে তিনি নিজেই নিজেকে ‘বিপদনাশিনী দেবী’ আখ্যায়িত করেন। এলাকায় জানাজানি হওয়ায় অনেকেই তার এসব কাজের বিরোধিতা করেন। কেউ কেউ আবার, বিপদনাশিনীর আশ্রয় ভেবে নিজেদের সমস্যা নিয়ে তার বাড়িতে ছুটে যান। অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, তার সহচর হিসেবে কাজ করেন কয়েকজন যুবক।
এলাকাবাসীর অনেকেই বলেন, এখানে মন্দির হয়েছে আমরা জানি। মন্দিরে পূজা পার্বন হবে । কিন্তু শিপ্রা রানীর মন্দিরে অশ্লীল নৃত্য আর অপচিকিৎসা চলে হরদম। যা আমরা মেনে নিতে পারি না বলে সেখানে যাওয়া হয় না।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ভানুলাল রায় জাগো নিউজকে বলেন, সে প্রতারক, অনেক অভিযোগ শুনতে পাচ্ছি। এখানে এক নারীকে চিকিৎসার নামে পেটানো হয়। সে ধর্মীয় নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে এসব করে যাচ্ছে। হিন্দু ধর্মীয় পূজা বিধির ও রীতির তোয়াক্কা না করে নিজ ফর্মুলায় বিভিন্ন ধর্মীয় কর্মকাণ্ড করছে।
এ বিষয়ে শিপ্রা রানী দেবের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জাগো নিউজ বলেন, আমার এখানে মানুষ আসলে আমি ভালো করে দেই। আমার মাঝে দেবী আছেন। অভিযোগের বিষয়গুলো জানতে চাইলে কথা বলতে চাননি।
মৌলভীবাজারের সিভিল সার্জন সত্যকাম চক্রবর্তী জাগো নিউজকে জানান, আমি বিষয়টি শুনেছি। মৌলভীবাজারের রাইরে আছি, ফিরেই খবর নেব। তবে কেউ লিখিত অভিযোগ দিলে সরাসরি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সহজ হয়।
দৈনিকদেশজনতা/ এফ আর