২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৯ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | বিকাল ৪:১৯

সীমান্তে রোহিঙ্গাদের ঢল নেমেছে: রাখাইনে চলছে রক্তের হোলিখেলা

উখিয়া (কক্সবাজার) প্রতিনিধি :
মিয়ামারে সহিংসতার পর থেকে হাজার হাজার রোহিঙ্গা এদেশে অনুপ্রবেশ করে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্র“ পশ্চিম কুল পয়েন্ট, উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের বালুখালী শফিউল্লাহ কাটার ঢালা, থাইংখালীর তাজনিমার খোলা ও হাকিম পাড়ার বনবিভাগের বিশাল এলাকা জুড়ে গড়ে তুলেছে নতুন রোহিঙ্গা বস্তি। পুরোদমে চলছে ছোট -ছোট তাবু স্থাপনের কাজ। প্রায় ৪টি নতুন বস্তিতে আশ্রয় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। গতকাল মঙ্গলবার সকালে উখিয়া উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পালংখালী ইউনিয়নের জামতলী বাগানে অবৈধ ভাবে বস্তি স্থাপনকারী ১ হাজার ঝুপড়ি উচ্ছেদ করেছেন। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) মোজাফ্ফর আহমদ সত্যতা স্বীকার করেন। সরেজমিনে ঘুরে ও প্রত্যক্ষদর্শীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, মিয়ানমারের ওয়াবেং গ্রামের স্বামী হারানো রোহিঙ্গা নারী মমতাজ বেগম (২৮) কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, তার স্বামী আবুল ফয়েজকে মিয়ানমারের মগ সেনারা ধরে নিয়ে গুলি করে মেরেছে। শিশু সন্তান নিয়ে অন্যদের সহযোগিতায় টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের কাঞ্জর পাড়া হয়ে এপারে চলে আসি। কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের বালুখালী টিভি রিলি কেন্দ্রে সংলগ্ন তাবুতে আশ্রয় নেওয়া শাহাব বাজার এলাকার মৃত আশরফ আলীর ছেলে আলী আহমদ (৭০) বলেন, গত ৩ দিন আগে বাড়ি থেকে বের হয়েছি। মগ সেনারা বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। এখনো পর্যন্ত কোন কিছু খেতে পারেনি। ছোট একটি তাবুতে আশ্রয় নিয়েছি। স্থানীয় কুতুপালংয়ের ভুট্টো নামের এক যুবককে ২ হাজার টাকা চাঁদা দিলে ঝুপড়ি ঘর তৈরি করতে পারব। পরিবারের সদস্য সংখ্যা ১১ জন। তৎমধ্যে ৭ জন ছেলে, ২ জন মেয়ে। মিয়ানমারের মংডু গারদ বিল গ্রামের মৃত আবদুল হামিদের ছেলে এজাহার হোসেন (৫৫) বলেন, তার এলাকায় ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছেন মগ সেনারা। এখনো পর্যন্ত এসব স্মৃতি চোখে ভাসছে। তাদের স্বজনের আহাজারি এখানকার পরিবেশও ভারি হয়ে উঠছে। বর্তমানে রাখাইনে চলছে রক্তের হোলিখেলা। যার ফলে বলতে গেলে মিয়ানমার সেনাবাহিনী সীমান্ত খোলে দিয়েছে। একারণে হাজার হাজার রোহিঙ্গারা দিনে রাতে বাংলাদেশে চলে আসছে। হাকিম পাড়া বস্তিতে আশ্রয় নেওয়া মোঃ করিম জানান, মিয়ানমার সেনাবাহিনীরা গত বৃহস্পতির হইতে ১৫ হাজার রোহিঙ্গাকে ঘিরে রাখলেও গত বৃহস্পতিবার থেকে সীমান্ত খুলে দিয়েছে। বালুখালীর টালে আশ্রয় নেওয়া জামাল হোসেন বলেন, আমার বাবাকে ধরে নিয়ে গেছে। এখনো পর্যন্ত বেঁচে আছে কিনা জানিনা। মা এর মুখ থেকে কোন কিছুই বের হচ্ছে না। ঝিমনখালী গ্রামের মৃত আবদুর রহমানের ছেলে নুর মোহাম্মদ (৫০) বলেন, তার একটি ছেলে মগ সেনাদের গুলিতে আহত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার কবরও দিতে পারিনি। হাকিম পাড়ার বস্তিতে আশ্রয় নেওয়া রহিমা খাতুন, আজু মেহের বলেন, অবাজি ইন কি দেইখ্যি, জীবনতও এনগরি ঘর বাড়ি পুরি দিয়ে, মানুষ মাইজ্জেদে ন দেখি। আর দুয়া পুয়া খুজি ন পাই। ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান একেএম জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, গতকাল বিকেলে মিয়ানমার-তুমব্র“ সীমান্তে ৫টি স্থল মাইন বোমা বিস্ফোরনের শব্দ শুনেছি এবং ১ জন আহত হয়েছে বলে জানা গেছে। রোহিঙ্গাদের মানবিক সাহায্য সহযোগীতা দিচ্ছে, এরাও মানুষ। সীমান্ত এলাকায় বিজিবির সদস্যরা রাতদিন পরিশ্রম করছে। অনুপ্রবেশে ঠেকাতে তৎপর রয়েছে বিজিবির জোয়ানরা। টহলরত ঘুমধুম বিজিবির নায়েবে সুবেদার রফিকুল ইসলাম বলেন জড়ো হওয়া রোহিঙ্গারা যাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে না যায়, তা দেখা হচ্ছে। পুশব্যাক করা হবে কিনা জানতে চাইলে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতির অপেক্ষায় আছেন বলে জানান তিনি।এদিকে বালুখালীতে বনভুমির কয়েক শত জায়গায় গড়ে ওঠছে নতুন আরেকটি রোহিঙ্গা বস্তি। যে বস্তি গড়াঁর পেছনে সাবেক মেম্বার ও পালংখালী ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ফজল কাদের ভুট্টো, জামায়াত নেতা আকবর আহমদ, থাইংখালীর চেয়ারম্যান সমর্থিত একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গোপনে নেতৃত্ব দিচ্ছে বলে স্থানীয়দের অনেকেই জানান। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে ফজল কাদের ভুট্টো বলেন, যেখানে রোহিঙ্গা বস্তি হচ্ছে, সেখানে আমার বহু জমি বেদখলে চলে গেছে। আমি যতদ্রত সম্ভব রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান চাই। রোহিঙ্গারা চলে গেলে আমি খুশী। থাইংখালীর ভারপ্রাপ্ত বনবিট কর্মকর্তা মাসুম সরকার বলেন, বনভুমি দখল করে রোহিঙ্গা বস্তি করতে যাওয়ায় বাধা দিলে স্থানীয় কিছু বখাটে চক্র আমার সাথে তর্কে জড়ায়। বিষয়টি আমি ইউএনও সহ বনবিভাগের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট অবহিত করেছি। তবে নতুন অনুপ্রবেশ করে এপারে আশ্রিত রোহিঙ্গা বলেন, আরাকান রাজ্যের বিভিন্ন গ্রামে অগ্নিকান্ডে আগুনের লেলিহান শিখা সীমান্ত এলাকা থেকে দেখা যাচ্ছে। আতংকিত রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের উখিয়া – টেকনাফের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে এপারে ঢুকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও আত্মীয় স্বজনের বাড়ীতে আশ্রয় নিচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে। উখিয়া সংলগ্ন নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার রেজু আমতলী, তুমব্রু সীমান্ত পয়েন্টে দিয়ে কয়েক হাজারের বেশী রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় আছে। ওই এলাকার জিরো পয়েন্টে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে গিয়ে বিজিবির হাতে আটকা পড়েছে। সীমান্তে জড়ো হয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের আতঙ্কিত করতে মিয়ানমার বিজিপি সকালে গুলি ছুঁড়েছে এবং বিজিপির ছোঁড়া গুলিতে হতাহতের ঘটনাও ঘটছে। শনিবার বিকেলে রোহিঙ্গা স্বামী -স্ত্রীর মরদেহ পাওয়া গেছে জিরো লাইনের অভ্যান্তরে।
রোহিঙ্গাদের আর্তনাদে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠে। বিজিবি সীমান্তে কড়া পাহারায় রয়েছে এবং অতিরিক্ত টহল জোরদার করেছে। উখিয়ার পার্শ্ববর্তী ঘুমধুম, তুমব্রু, জলপাইতলীর নুরুল ইসলামের আমবাগান, পশ্চিমকুলের বাশঁ বাগান, উখিয়ার রহমতের বিল, ধামনখালী, বালুখালী, পালংখালী পয়েন্ট দিয়ে দিন-দিন রোহিঙ্গারা জিরো পয়েন্টে জটলা বাধছে। সীমান্তের পরিস্থিতি দেখতে ২৭ আগস্ট বিকালে বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন মিয়ানমার সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের ঘুমধুম জলপাইতলী এলাকা পরিদর্শণ করে গেছেন। ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান একেএম জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন প্রায়
প্রতিদিনই মিয়ানমার অভ্যান্তরে গুলির শব্দ শোনা যায়। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চিত্রও দেখা যায়। এদিকে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা টেকনাফের হোয়াইক্যং উলুবনিয়া, লম্বাবিল, খারাইংগ্যা ঘোনা, উখিয়ার পালংখালী এলাকা দিয়ে শত শত রোহিঙ্গা নাফনদী অতিক্রম করে সীমান্তের উপকূলীয় বিভিন্ন কেওড়া বনে লুকিয়ে থাকছে বলে জানা গেছে। এসব রোহিঙ্গারা রাতের আধারে অনুপ্রবেশ করে টেকনাফের লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্প, নয়াপাড়া শারণার্থী ক্যাস্প, উখিয়া কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্প, কুতুপালং ও বালুখালী অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাস্পে সুযোগ বুঝে আশ্রয় নিচ্ছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, মিয়ানমার সেনাবাহীনি ঘর বাড়ী জ্বালিয়ে দিচ্ছে। পুুরুষদের ধরে গুলি করে হত্যা করছে। মহিলাদের নির্যাতন ও ধর্ষণ করা হচ্ছে। রোহিঙ্গারা আতংকে পাহাড়, ধান ক্ষেতে ও বনজঙ্গলে পালিয়ে লুকিয়ে আছে। হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে। কিন্তু বিজিবি বাধা দেওয়ায় কেউ ঢুকতে পারছেনা। তারা রাতের আধারে বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে অনুপ্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছে বলে জানান। পালিয়ে আসা মিয়ানমারের ঢেকিবনিয়ার দিল মোহাম্মদ ও মিনারা বেগম জানান, সেনা বাহিনীরা গ্রামে ঢুকে অত্যাচার করছে। পুরুষদের ধরে নির্যাতন চালিয়ে গুলি করে হত্যা করছে। গ্রামে অগ্নি সংযোগ করে পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে। প্রায় সময় মিয়ানমারের মগ সেনাদের তান্ডব চলছে।
অপরদিকে, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গুলিতে ৫ রোহিঙ্গা আহত হয়েছে। তারা হলেন, বুচিদং দম বাজারের মোহাম্মদ শোয়াইবের স্ত্রী সিরাজুন নেছা (৩২), তার মেয়ে উম্মে সালমা (১৩), ছৈয়দ নুরের ছেলে আবু ছিদ্দিক (৪০), জহির হোসেনের ছেলে মোহাম্মদ সাদেক (৩২)। এদের সবাইকে উখিয়ার কুতুপালং এমএসএফ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
৫০ রোহিঙ্গা আটক:
কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের চেকপোষ্টে যানবাহন তল্লাশী করে মিয়ানমারের ৫০ জন রোহিঙ্গা নাগরিককে আটক করেছে। সোমবার রাতেই র‌্যাব- ৭ এর একটি দল তাদের আটক করে। আটককৃতদের ৩৪ বিজিবির আওতাধীন ঘুমধুম বিজিবিকে হস্তান্তর করেছে বলে মেজর রুহুল আমিন জানিয়েছেন।

দৈনিক দেশজনতা /এন আর

 

প্রকাশ :সেপ্টেম্বর ৫, ২০১৭ ৯:২০ অপরাহ্ণ