২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৯ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সকাল ১০:২৭

মৃত্যুঞ্জয়ী,শ্রীমতি মঞ্জু ব্যানার্জী

শিল্পসাহিত্য ডেস্ক:

দিদি, শ্রীমতি মঞ্জু ব্যানার্জী বরিশালের গারুরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা শ্রী বিজয় কৃষ্ণ ব্যানার্জী ও মা অঞ্জলী ব্যানার্জীর প্রথম কন্যা তিনি। স্কুল, কলেজে পড়ালেখার সুবাদে প্রথম হতে পারেননি বটে তবে আত্মত্যাগে তিনি আমার মত অনেকের কাছেই প্রথম। বাবা মায়ের প্রথম সন্তান হিসেবে আদর ভালবাসা কতটুকু পেয়েছেন জানি না তবে দায়িত্বের বহর ছিল ভীষণ ভারী। বাবা, মা, ও নয়ভাই বোনের সবটুকু দায়িত্ব নিতে হয়েছে দিদি কে। অনেক সন্তানের ভারে মায়ের দিনগুলো হয়ে উঠছিল কঠিন থেকে কঠিনতর। মাঝ পথে এসে মা একরকম হাল ছেড়ে দিলেন। ক্লান্ত মা দিদিকে সমস্ত সংসারটাই বুঝিয়ে দিলেন। দিদির কৈশোর ছিল না। যৌবন ছিল না। ছিল শুধু দায়িত্বভারে জর্জরিত একঘেয়ে সময়। মেয়েদের সুইট সিক্সটিন-এ দিদিকে হয়ে উঠতে হয়েছে সম্পূর্ণা ।দায়িত্ব ও কর্তব্যের ভারে ভারী হয়ে উঠেছিল দিদির জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত।

বাবার সংসার গুছিয়ে দিন শেষে হারিকেনের আলোয় একটু-আধটু লেখাপড়া করে দিদি তার মেধার বলে মেট্রিকুলেশন করেন। ততদিনে ভাইয়েরা কিছুটা বড় হয়ে উঠছে। তারা যথেষ্ট বিবেচক ছিলেন। তারা সবাই দিদির ভার লাঘবে সচেষ্ট ছিলেন। কিন্তু সংসার বলে কথা! ভাইদের যথেষ্ট পড়ালেখার সুযোগ করে দিতে গিয়ে দিদির পড়া আর এগোয় না।

সংসারে এক এক করে নতুন ভাই- বোনেরা আসছে, দিদির জন্য নতুন নতুন দায়িত্বের বোঝা নিয়ে। অকাতরে হাসিমুখে দিদি সামলেছেন সব। দিদিকে একটি গান গাইতে প্রায়শই শুনতাম,
‘একটি নমস্কারে প্রভু একটি নমস্কারে
সমস্ত মন লুটিয়ে পড়ুক তোমার সংসারে।’

সত্যনিষ্ঠ দিদি বাবার সংসারে তাই করেছেন। কোথাও কোনো ফাঁক রাখেননি। অনুজ ভাই দুটি বড় হয়ে ওঠার ফাঁকে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে দিদি উচ্চ মাধ্যমিক সম্পূর্ণ করেন শুধুই মনোবল দিয়ে। তারপর জলাঞ্জলি দিলেন নিজের মেধা, নিজের যৌবন। আর সব মেয়েদের মত দিদি কখনো নিজের আবেগকে প্রশ্রয় দেওয়ার সুযোগ পাননি কারণ ততদিনে অনুজ নয় ভাইবোনের রাশি রাশি দায়িত্ব দিদির মনের প্রতিটি কোণ দখল করে ফেলেছে। এর মাঝে দাঙ্গা এলো।

এলো ১৯৭১। আলোর পথ যাত্রী আমার দিদি সেই অর্থে মুক্তিযুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছেন যে অর্থে বাংলাদেশের মা বোনেরা আশ্রয় দান করে, সেবা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের এগিয়ে দিয়েছেন বিজয়ের পথে।পরবর্তীতে দিদি দীর্ঘ সময় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাথে যুক্ত থাকেন।

১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের পর শুরু হল আমাদের পরিবারের নতুন অধ্যায়।। গারুরিয়ার পাত গুটিয়ে সবাইকে নিয়ে বাবার সংসার চলে এল ঢাকায়। দিদি কিন্তু সংসারের চাপে উচ্চ মাধ্যমিকের পর আর পড়ালেখার সুযোগ পাননি। সারাদিন একটি আটপৌরে শাড়ি পরে গভীর রাতে মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুলে চিরুনি দিতে পেরেছেন কি পারেননি তার মধ্যে পড়ালেখার জায়গা কোথায়?

ঢাকা এসে বড় দুই ভাই সংসারের ভার- বিশেষভাবে অর্থনৈতিক ভার নিলেন। তারা বিবেকবান হয়েছেন। দিদিকে অনেক বোঝালেন বয়সের চাওয়া-পাওয়ার কথা, নিজের ঘর-সংসারের কথা। কিন্তু দিদি তাঁর জীবনবোধের মধ্য দিয়ে কঠিন সত্যকে বুঝেছেন ততদিনে একেবারে পরিপূর্ণভাবে। তাই বাবা, মা আর ভাইদের সাথে থেকে গেলেন পরের চার বোনের ভবিষ্যতের কথা ভেবে। ক্রমে ক্রমে মা শারীরিক এবং মানসিকভাবে দুর্বল হতে থাকলেন।

ভাইয়েরা বড় হচ্ছে, বোনরা বড় হচ্ছে। দিদি প্রস্তুত হলেন এক এক করে ভাই বোনদের বিয়ে দেবার জন্য। বিয়ে করিয়েছেন, নতুন মানুষদেরকে যোগ্য আয়োজন ও সম্মানের সাথে ঘরে এনেছেন। কখনো আফসোস ছিল না। রবীন্দ্রনাথ, নজরুলকে প্রবলভাবে ভালবেসেছেন। অনেক কাজের মাঝে রবীন্দ্রনাথ পড়া ও শোনা ছিল দিদির একমাত্র শখ, সাথে অন্যান্য লেখকদের প্রবন্ধ ও পত্রিকা পড়তে ভালবাসতেন।

ভাইবোনরা সবাই যখন বড় হলো নিঃস্বার্থ, কঠোর পরিশ্রমী দিদি আরো দুটি ডিগ্রী অর্জন করলেন- বি.এ এবং বি.এড।

আমরা যখন সবাই বড় হলাম, একটু একটু করে দিদির দায়িত্বের ধরণ বদলালো কিন্তু কমলো না। বরং অনেক মানুষের সংসারে দায়িত্বের সাথে সাথে দিদির জীবনে যোগ হল নতুন নতুন মানসিক দ্বন্দ্ব। দিদির মত স্বার্থত্যাগী হবার প্রয়োজন এবং মনোভাব সবার হয় না, তাই দিদিকে মুল্যায়নের ক্ষমতাও আমাদের নেই।দিদি এবার পরিবারের গণ্ডি পেরিয়ে সমাজ সেবার পথে এগোলেন।

আর এতদিনে দিদির নিজের করে সংসারের বয়সও শেষ হবার পথে। তাই দিদি এবার অন্য এক যাত্রায় বেরোলেন যেখানে পরিবারের চাইতেও সামষ্টিক চিন্তায় তিনি তাড়িত হয়েছেন। আমাদের প্রিয় শিবানীদির হাত ধরে এক পা দু পা করে সংসারের কাজের ভীড় ঠেলে তিনি ঘরের বাহির হলেন। ধীরে ধীরে শিক্ষকতায় নিজেকে নিয়োজিত করলেন। আরো একটু এগিয়ে দিদি অক্লান্ত পরিশ্রম করে প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য একটি স্কুল খুলতে সক্ষম হলেন। স্কুলের নাম স্কলার্স স্পেশাল স্কুল।

পরিশ্রমের ফসল হিসেবে আরেকটি প্রচেষ্টা সফল হলো। তিনি একই বিদ্যালয় ভবনে পথশিশুদের স্কুল খুললেন বৈকালিক ভাগে। এবারে অন্তহীন দায়িত্ব- স্কুলের কাজ, ভাইবোনদের দেখভাল এবং ভাইবোনদের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যত গড়ার কাজ একসাথে চলল। ভাইবোনেরা জীবনে প্রতিষ্ঠিত হলো দিদির আত্মত্যাগের বিনিময়ে।

কিন্তু সময় দিদিকে ছাড় দিল না। ২০১৬-তে এসে দিদি আক্রান্ত হলেন ক্যান্সারে। অসুখ ধরা পড়তে পড়তে অনেকটাই ক্ষতি হয়ে গেছে। আগে থেকেই সিদ্ধান্ত ছিল। ক্যামো চলাকালীন তা চূড়ান্ত রূপ নিল যে দিদি তার নশ্বর দেহটিও মানুষের সেবায় দান করবেন। সারা জীবন যিনি ভাইবোন, আত্মীয়-পরিজনের সেবা করেছেন, তিনি তার দেহখানি দান করলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে।

২০১৬ সালের ৩০শে আগস্ট চিরকালের নির্মোহ, স্বার্থত্যাগী, সবার প্রিয় দিদি, সবাইকে শূন্য করে দিয়ে চলে গেলেন অসীমে। দিদি তোমার জন্য অশেষ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা-
‘নমি নমি চরণে
নমি চির কলুষ হরণে।’

একটা একটা করে বছর যাবে। চলমান-জীবন চলবে। হারানোর শোক তীব্রতা হারাবে, স্মৃতি ধূসর হয়ে যাবে। তবে সংসার ও সমাজের জন্য অবদানের, আত্মত্যাগের মহিমায় দিদি সময়কে জয় করে, মৃত্যুকে জয় করে আমাদের মাঝে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

আমার এই লেখাটি আমার পরম মমতাময়ী আত্মত্যাগী দিদির প্রথম প্রয়াণবার্ষিকীতে সামান্য শ্রদ্ধার্ঘ। দিদিকে স্মরণ করার এই রচনার শেষে আমি আমাদের সমাজ, সংসারে যে সকল নারী নীরবে, নিভৃতে, নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন, নিঃশেষ করেছেন নিজেকে অন্য সবার জন্য, তাদের সবাইকে অন্তরের গভীর থেকে ভালবাসা ও শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।

কল্যাণী ব্যানার্জী : সহযোগী অধ্যাপক, কবি নজরুল সরকারি কলেজ।

দৈনিক দেশজনতা/এন এইচ

প্রকাশ :আগস্ট ৩১, ২০১৭ ১১:৫৫ পূর্বাহ্ণ