২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৯ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | দুপুর ১২:১৭

ব্যাংকিংখাত স্বচ্ছ না হলে বিনিয়োগ বাড়বে না

নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশের ব্যাংকিংখাতে বড় ধরনের অস্বচ্ছতা রয়েছে। জনগণের আমানতের টাকাই সরকারি ব্যাংকের সম্পদ। কিন্তু রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ওই টাকা দুর্বৃত্তদের হাতে চলে যাচ্ছে। কিন্তু এই দুর্বৃত্তদের বিচার না করে জনগণের টাকায় বাজেট থেকে আবারও ব্যাংকগুলোকে মূলধন সংগ্রহ করা হচ্ছে। ফলে ব্যাংকিংখাত স্বচ্ছ না হলে বেসরকারিখাতে বিনিয়োগ বাড়বে না।

শনিবার রাজধানীর হোটেল লেকশোরে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) আয়োজিত বাজেট সংলাপে বক্তারা এসব কথা বলেন।

বক্তাদের মতে, বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে তিনটি বিষয় জরুরি। এর মধ্যে রয়েছে সুশাসন, বিনিয়োগের জন্য প্রণোদনা এবং স্বচ্ছ ব্যাংকিংখাত। কিন্তু এই তিন উপাদানের কোনোটিই এবারের বাজেটে প্রতিফলিত হয়নি। এছাড়াও বাজেটে ব্যবসায়ীদের দাবি আমলে নেয়া হয়নি। ভ্যাট বাড়িয়ে উৎপাদনশীল খাতকে চ্যালেঞ্জে ফেলা হয়েছে। অর্থাৎ এবারের বাজেটে যে কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়বে না।

সিপিডির চেয়ারম্যান ড. রেহমান সোবহানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ও বিএনপি নেতা আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এম আকবর আলি খান, সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ইনাম আহমেদ চৌধুরী, ব্যবসায়ী নেতা আসিফ ইব্রাহিম, ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবির সাবেক প্রেসিডেন্ট নুরুল আমিন। এছাড়াও দেশের সাবেক সচিব, শীর্ষ স্থানীয় অর্থনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা, বিভিন্ন দেশের দুতাবাসের প্রতিনিধি এবং ব্যবসায়ী নেতারা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।

অনুষ্ঠানে মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন।

ড. আকবর আলি খান বলেন, অর্থনীতিতে মূল সমস্যা ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগের অভাব। কিন্তু এবারের বাজেটেও বিনিয়োগ বাড়াতে তেমন পদক্ষেপ নেই। কারণ বিনিয়োগের জন্য তিনটি বিষয় জরুরি। যা হল সুশাসন প্রতিষ্ঠা, বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রণোদনা এবং স্বচ্ছ ব্যাংকিংখাত। কিন্তু ব্যাংকিংখাতের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ।

তিনি বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলো জনগণের টাকায় সম্পদ গড়ছে। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে ওই সম্পদ দুর্বৃত্তদের হাতে চলে যাচ্ছে। দিনের পর দিন অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। কিন্তু বাজেট থেকে অর্থ বরাদ্দ করে ব্যাংকগুলোকে সহায়তা দেয়া হচ্ছে। ফলে ব্যাংকিংখাত স্বচ্ছ না হলে বেসরকারিখাতে বিনিয়োগ বাড়বে না।

তিনি বলেন, দেশের বাজেট প্রক্রিয়া একবারে অস্বচ্ছ। এখানে কোনো স্বচ্ছতা নেই। কীভাবে বড় বাজেট বাস্তবায়ন হবে। কোন উপখাত থেকে কত অর্থ আসবে, তা সুস্পষ্ট নয়।

ড. আকবর আলি খান বলেন, ১৫ শতাংশ ভ্যাট আদায়ের কথা বলা হয়েছে। এতে বেশ কিছু পণ্যের দাম বাড়বে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ ও বেশ কিছু নিত্যপণ্য রয়েছে, যার ওপর ভ্যাটের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

তিনি বলেন, অফিসিয়ালি বাংলাদেশ এখনও মধ্যম আয়ের দেশ হয়নি। ফলে এ ধরনের দেশের জন্য সবখাতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নীতিমালার পরিপন্থী।

তিনি আরও বলেন, ভ্যাটের হারের চেয়ে নিয়মিত ভ্যাট আদায় জরুরি। যারা কর ফাকি দেয়, তাদেরকে চিহ্নিত করতে হবে।

তার মতে, বাজেটের বড় দুর্বলতা হল জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ততা নেই। ১৭৭০ সালে যেভাবে ছিল, বর্তমানেও বাজেটে কাঠামো ওইভাবেই রয়েছে। এখানে মৌলিক কোনো পরিবর্তন হয়নি। প্রধানমন্ত্রী কিছু দিক নির্দেশনা দেন, এরপর আমলারা বাজেট তৈরি করে এবং অর্থমন্ত্রী সংসদে উপস্থাপন করেন। সাবেক অর্থমন্ত্রীদেরও কোনো মতামত নেয়া হয় না।

তিনি বলেন, মন্ত্রীদের কোনোভাবেই সংসদে বাজেটের সমালোচনা করার সুযোগ নেই। কারণ বাজেট নিয়ে কেবিনেটে কথা হয়। কিন্তু মূল সমস্যা হল বাজেটে সংসদীয় কমিটি এবং সংসদ সদস্যদের সম্পৃক্ততা নেই।

তিনি বলেন, দীর্ঘদিন পর্যন্ত দেশে সংসদ কার্যকর নেই। সংসদে কোনো প্রতিপক্ষ নেই। ফলে সংসদের মাধ্যমে একটি টাস্কফোর্স গঠন করে বাজেটের সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে।

ড. আকবর আলি খান বলেন, এবারের বাজেটে স্বাস্থ্যখাত এবং রেলওয়েতে একইসমান বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কিন্তু এটা স্বাস্থ্যখাতের প্রতি অবহেলা। কারণ এখাতের সঙ্গে ১৬ কোটি মানুষ জড়িত। আর স্বাস্থ্যসেবার বিকল্প কোনো পথ নেই। কিন্তু রেলের বিকল্প নৌ এবং সড়ক পথ রয়েছে। ফলে এটি পুনর্বিবেচনা করা উচিত।

তিনি বলেন, দেশের রেমিট্যান্স (প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ) আয় কমছে। সাম্প্রতিক সময়ে কাতারের সমস্যার কারণে রেমিট্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এই রেমিট্যান্স বাড়াতে পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়া ব্যাংকের আবগারি শুল্ক পুণঃবিবেচনা করতে হবে।

সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বেসরকারিখাতের বিনিয়োগ ছাড়া অর্থনীতি আগাতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশে বিনিয়োগ হচ্ছে না। সরকার বড় বড় প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী স্বৈরাচারী সরকারগুলো বড় প্রকল্পে নজর দেয়। তারা উন্নয়নের জোয়ার দেখাতে বড় বড় বিল্ডিং বা স্থাপনা বানায়। বাংলাদেশেও তেমনটি ঘটছে। কারণ সরকারের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ। এখান থেকে জনগণের চোখ সরাতে বড় প্রকল্প বানাচ্ছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে লুটপাট হয়।

উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ৮ হাজার কোটি টাকার পদ্মাসেতুর ব্যয় এখন ২৮ হাজার কোটি টাকায় দাড়িয়েছে। শিগগিরই এটি ৪০ হাজার কোটি টাকা হয়ে যাবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে চার লেনদেনের এক কিলোমিটার রাস্তা তৈরিতে ব্যয় হয় ৫৪ কোটি টাকা। ইউরোপে এই ব্যয় ২৮ কোটি টাকা এবং চীনে তা ১২ থেকে ১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি করা যায়।

তিনি আরও বলেন, বিনিয়োগ না হওয়ায় দেশের বাইরে টাকা পাচার হচ্ছে। প্রতিবছর থেকে ৬০ থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের একাউন্ট বাড়ছে, পানামা পেপার্সে নাম আসছে, অফশোর ব্যাংকিং হচ্ছে। এটি দেখার কেউ নেই।

তিনি আরও বলেন, বিনিয়োগের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অন্যতম শর্ত। কিন্তু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাতো দুরের কথা, দেশে বৈধ অর্থনীতি কার্যকর নেই। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নেই। মানবাধিকার লংঘন হচ্ছে। এই অবস্থায় কে বিনিয়োগ করতে আসবে, প্রশ্ন রাখেন তিনি।

মূলপ্রবন্ধে ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, আগামী বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৭ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি। এই হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য অতিরিক্ত ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত বিনিয়োগ লাগবে। এরমধ্যে সরকারি বিনিয়োগ ৫০ হাজার কোটি টাকা এবং বেসরকারি বিনিয়োগ ৬৬ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বর্তমানে কাঠামোতে এক বছরে এই পরিমাণ বিনিয়োগ সম্ভব নয়।

দৈনিক দেশজনতা/এন আর

 

প্রকাশ :জুন ১৭, ২০১৭ ৮:৪২ অপরাহ্ণ