৩রা ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং | ১৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১১:২৪

চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডি: আশ্বাসেই কেটে গেছে বছর

তিন ভাই আর এক বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন মাসুদ রানা, আর মাহবুবুর রাহমান রাজু মেজো। বোনের বিয়ে হয়েছে।  আর ছোট ভাই লেখাপড়া করছে। তাদের বৃদ্ধ বাবা-মা দুজনেই শাসকষ্ট, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা রোগে আক্রান্ত। বাবার হার্টে রিং পরানো। এই পরিবারে আরও আছেন মাসুদ ও মাহবুবের দুই স্ত্রী এবং তাদের দুই শিশু সন্তান।

পুরান ঢাকার চকবাজারে চুরিহাট্টার ওয়াহিদ ম্যানশনের নিচে ‘এম আর টেলিকম সেন্টার’ নামে ফ্লেক্সিলোডের দোকান চালাতেন মাসুদ আর  মাহবুব। দুই ভাইয়ের রোজগারেই চলতোএতগুলো মানুষের এই পরিবারটি।

কিন্তু সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায় গত বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে। রাত ১০টা ৩২ মিনিটে ওয়াহিদ ম্যানশনে আগুন লাগলে দোকান থেকে বের হয়ে মাসুদ আর মাহবুব দৌড়ে গিয়ে আশ্রয় নিলেন পাশের গলিতে। সেখানেই অনেকের সঙ্গে দম বন্ধ হয়ে মারা যান এই দুই ভাই।

বুধবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) রাতে উর্দু রোডের বাসায় কথা হয় মাসুদ আর  মাহবুবের বৃদ্ধ মা মালেকা বেগমের সঙ্গে।  ভয়াবহ সেই আগুনের ঘটনা স্মরণ করে মালেকা বেগম বলেন,  ‘কিন্তু বাইর হইবার পারে নাই, সামনেতো আগুন। বাইর হইবার পথ পায় নাই। পেছনের গেইট ছিল, সেই গেইটও তালা মারা ছিল। ওই গলিতে যত মানুষ ছিল, সবাই নিঃশ্বাস না নিতে পারায় মারা গেছে। পরদিন সকালে সবাইকে পাওয়া যায়— সব পোড়া, গলা।’

তিনি জানান, পরদিন (২১ ফেব্রুয়ারি) সকাল সাতটার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ছেলেদের পাওয়া গেছে। ওরাতো আগুনে পুড়ে নাই। নিঃশ্বাস আটকে মারা গেছে। তাই গায়ের কিছু পোড়ে নাই। কিন্তু ছেলেরা আর বাঁচে নাই, আমার দুই রাজপুত্র…।’

উর্দু রোডের বাসা থেকে মালেকা বেগম সেই অভিশপ্ত রাতে চুড়িহাট্টার আগুন দেখতে পান। অজানা আশঙ্কায় কেঁপে ওঠেন তিনি। কিন্তু ভাবতেও পারেননি, ১৫ মিনিট আগে যে দুই ছেলে তাকে ডাক্তার দেখিয়ে বিদায় দিলো, সেটাই ছিল সন্তানদের সঙ্গে তার শেষ দেখা। তিনি বলেন, ‘কী যে জ্যাম ছিল সেদিন!’

দুই ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় মালেকা বেগম বলেন, ‘ছেলেটার হাত ধরে ছিলাম। যদি জানতাম আর কোনোদিন হাত ধরতে পারবো না, তাইলে আমিও আর হাত ছাড়তাম না…।’

এসময় পাশের ঘর থেকে শিশুর কান্নার আওয়াজ আসে। মালেকা বেগম বসার ঘর থেকে উঠে যান। কোলে করে নিয়ে আসেন শিশুটিকে। বললেন, ‘এটা রাজুর (মেজো ছেলে) সন্তান, চার মাস বয়স।’ মারা যাওয়ার ২০ দিন আগে বিয়ে হয়েছিল রাজুর। ‘সন্তানের মুখ দেখাতো দূরের কথা, সন্তান আগমনের খবরটাই জেনে যেতে পারেনি আমার রাজু।’, বললেন বৃদ্ধ মা।

মালেকা বেগম বলেন, ‘তিন ছেলে, এক মেয়ে, ছেলেবউ সবাইকে নিয়ে ছিল আমার  ভরা সংসার। বড় সুখী ছিলাম। কিন্তু সেই ভরা সংসার এখন শূন্য।’

তিনি বলেন, ‘এই ঘটনায় নাকি ৩০ কোটি টাকার মতো উঠছে, কিন্তু আমরাতো কিছুই পাইনি। একটা পয়সা দিয়েও কেউ সাহায্য করেনি। একটা বছর ধরে সবাই আশ্বাস দিছে, সরকার বলছে— আমাদের সহযোগিতা করবে। কিন্তু কিছুই পাইনি, কেবল দুইটা লাশের সঙ্গে ২০ হাজার করে ৪০ হাজার টাকা ছাড়া।’

মালেকা বেগম বলেন, ‘নগরভবনে গেলাম, কতদিন গেলাম। তারা বলছে দেবো-দেবো। কিন্তু কিছুই দেয় নাই। এ পর্যন্ত আর কোনও উত্তর পাই নাই।’

চুড়িহাট্টার আগুন কেড়ে নিয়েছে নোয়াখালীর জাফর আহমেদকেও। জানতে চাইলে তার ছেলে রাকিব হোসেন রাজু বলেন, ‘না না, সরকারের তরফ থেকে আমরা কিছু পাই নাই। কেবল লাশের সঙ্গে ২০ হাজার টাকা, আর প্লাস্টিক সমিতি এক লাখ দিয়েছে ঘর তৈরির জন্য। শুনেছিলাম, অনেকেই অনেক কিছু দেবে, কিন্তু পরে আর কিছুই পাই নাই।’

তিনি বলেন, ‘মেয়র সাঈদ খোকন বলছিলেন, সরকার টাকা দেবে। সে অনুযায়ী নগরভবনে গিয়ে কাগজপত্র জমা দিলাম। পরবর্তীতে ডাক দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ডাকও দেয় নাই, টাকাও পাই নাই।’ ক্ষতিপূরণ পেয়েছে এমন কেউ আছে, নাকি আপনারাই কেবল পাননি, জানতে চাইলে রাজু বলেন, ‘আমরাতো সবাই সবার খবর নেই এবং নিচ্ছি। আমার জানা মতে কেউই পায় নাই।’

একই কথা বলেন নিহত বিবি হালিমা শিল্পীর বোন সুলতানা আক্তার শান্তা। মেয়ের জন্য ওষুধ কিনতে গিয়ে সেই রাতে আগুনে পুড়ে মারা যান বিবি হালিমা শিল্পী। শান্তা বলেন, ‘অন্য একটি পরিবারের আরেকজনের সঙ্গে তার বোন শিল্পীর মরদেহ মিলিয়ে ফেলা হয়। তারা ডিএনএ স্যাম্পল মিলিয়ে সেখান থেকে তার বোনের মরদেহ নিয়ে আসেন। আর এই পুরো প্রক্রিয়াতে সময় চলে যায় অনেক। ডেথ সার্টিফিকেট সময় মতো না পাওয়ার কারণে সরকারের তরফ থেকে কোনও ধরনের অনুদান বা সাহায্য সহযোগিতা আমরা পাইনি, কেবল পেয়েছি আশ্বাস।’

ওই রাতের আগুনে শিকার হন রিকশাচালক আনোয়ার হোসেন। চুড়িহাট্টায় দগ্ধ হওয়ার পর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা তিনি। তারপর থেকে কামরাঙ্গীর চরে ছোট ছোট তিন ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে সংসারের হাল ধরেছেন অনোয়ারের স্ত্রী হাজেরা বেগম। খুব কষ্টে দিন কাটছে তাদের। মোবাইল ফোনে  হাজেরা বেগম বলেন, ‘বেঁচে থাকতে পুরো সংসারটা চলতো তার আয়ে। কিন্তু সে চলে যাবার পরতো আমরা রাস্তায় বসে গেছি।’ হাজেরা জানান, একটি খেলনার কারখানায় কাজ নিয়েছেন তিনি, বেতন পাঁচ হাজার টাকা। কিন্তু এই টাকায় কী হয়!’ বাসাভাড়াসহ সংসার খরচ চালাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে, বললেন— ‘আর পারছি না।’

হাজেরা বেগম আরও জানান, স্বামীর চিকিৎসার সময়ে ৫০ হাজার টাকা, আর মারা যাওয়ার পর ২০ হাজার টাকা তাদের দেওয়া হয়েছিল। এরপর আর কোনও টাকাপয়সা দেয়নি কেউ। ‘তবে সারাটা বছর ধরে অনেক আশ্বাসের কথা শুনেছি। যদিও কিছুই পাইনি’, বললেন দিশেহারা হাজেরা বেগম।

প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ওয়াহিদ ম্যানশনে ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ঘটে। এতে দগ্ধ হয়ে মারা যান ৭১ জন।

প্রকাশ :ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২০ ৫:৩০ অপরাহ্ণ