জিলাল হোসেন ও তার সহযোগীদের দুর্নীতির বিষয়ে দুদকে অভিযোগ জমা হয় গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর। বেলাল হোসেন ও আবদুল জব্বার নামে দুই ব্যক্তি দুদকে ওই অভিযোগ জমা দেন। যাচাই-বাছাই ও প্রাথমিক অনুসন্ধানের পর পূর্ণাঙ্গ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হয়। এরই অংশ হিসেবে গত ২৭ জানুয়ারি জিলাল ও তার সহযোগীদের বিষয়ে জানতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায় দুদক। চিঠিতে তদন্ত পূর্বক ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে দুদকে প্রতিবেদন পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দুদকের মহাপরিচালক (বিশেষ তদন্ত) সাঈদ মাহবুব খানের সই করা চিঠিটি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সেলিম রেজার কাছে পাঠিয়েছে দুদক।
মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, চিঠি পাওয়ার পর প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এক সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটির প্রধান হলেন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন অধিশাখার যুগ্মসচিব মোজাফফর আহমেদ। সূত্র জানিয়েছে, ৩০ কার্যদিবসের আগেই তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন দুদকে জমা দেওয়া হবে।
দুদকের অনুসন্ধানের বিষয়ে জানতে মহাপরিচালক (বিশেষ তদন্ত) সাঈদ মাহবুব খানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও এ বিষয়ে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
জিলালের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ এবং এ বিষয়ে দুদক ও মন্ত্রণালয়ের পৃথক অনুসন্ধান ও তদন্তের বিষয়ে হাইকমিশনের বক্তব্য জানতে ব্রুনাইয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে হাইকমিশনার এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) মাহমুদ হোসেনকে ফোনে পাওয়া যায়নি। আর জিলাল হোসেনের নম্বরে ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
দুদক ও মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, জিলালের বিরুদ্ধে ওঠা ১০টি অভিযোগ পৃথকভাবে অনুসন্ধান ও তদন্ত করছে দুদক ও মন্ত্রণালয়। দুদকের দাবি, এসব অভিযোগের সত্যতাও পাওয়া যাচ্ছে। ২৭তম বিসিএস (প্রশাসন) কর্মকর্তা জিলাল হোসেন সিন্ডিকেট তৈরি করে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন বলে দুদকের অনুসন্ধান ও মন্ত্রণালয়ের তদন্তে বেরিয়ে আসছে। দুদক ও মন্ত্রণালয় জিলালের অন্যতম সহযোগী হিসেবে হাইকমিশনের লেবার উইংয়ের কর্মকর্তা (দোভাষী) মো. আবু নাঈমকে চিহ্নিত করেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আবু নাঈমের বিরুদ্ধে ঢাকায় একটি ধর্ষণ মামলা আছে। ওই মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি হয়ে আছে। হাইকমিশনের ভেতরে প্রবাসী নির্যাতনের অভিযোগও আছে এই আবু নাঈমের বিরুদ্ধে।
জিলালের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
১. বাংলাদেশের বাইরে প্রতিটি দূতাবাস ও হাইকমিশনে নিজস্ব ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় ব্রুনাইয়েও হাইকমিশন ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ভবনের নকশা প্রণয়নের দরপত্র আহ্বান করে হাইকমিশন। নকশা প্রণয়নে খরচ হয়েছে ২০ লাখ টাকা। তবে জিলাল ও তার সহযোগীরা এক কোটি ৮০ লাখ টাকা খরচ দেখিয়েছেন।
২. হাইকমিশনের দোভাষী হিসেবে কাজ করেন মো. আবু নাঈম। ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার কামার গ্রামের খাঁ পাড়ার রাজা মিয়ার ছেলে নাঈম নারী নির্যাতন, প্রতারণা ও ধর্ষণ মামলার আসামি। রাজধানীর পশ্চিম শেওড়াপাড়ার এক নারী তার বিরুদ্ধে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে মামলা করেছেন। ওই মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। বিষয়টি হাইকমিশন জানলেও নাঈমের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। জিলাল হোসেন নেপথ্যে থেকে নাঈমকে রক্ষার চেষ্টা করছেন।
৩. বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়ার জন্য হাইকমিশনে ভিসা ছাড়পত্রের আবেদন করতে হয়। প্রত্যেক কর্মীর ছাড়পত্রের জন্য ১৫ ডলার করে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও জিলাল ও তার সহযোগী নাঈম ৫০০ থেকে ৬০০ ডলার করে আদায় করছেন। ছাড়পত্র নেওয়ার জন্য অতিরিক্ত টাকা দিতে অস্বীকার করায় আবেদন করা কোম্পানিকে কালো তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে।
৪. বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি নিতে সাইনবোর্ড সর্বস্ব কাগুজে কোম্পানির নামে ছাড়পত্র দেন জিলাল ও তার সিন্ডিকেট।
৫. বাংলাদেশ ভ্রমণে ইচ্ছুক ব্রুনাইয়ের পর্যটকদের ভিসা দিতে গড়িমসি এবং ঘুষ নেওয়ার অভিযোগও আছে জিলাল ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে।
৬. ব্রুনাইয়ে জনশক্তি রফতানি নিয়ন্ত্রণ করেন জিলাল। এ কাজে তার সহযোগীরা হলেন—মোরশেদ আলম শাহীন, শাহজালাল মাসুদ, মো. রতন, মো. আব্দুল্লাহ ও ফারুক সরকার।
৭. হাইকমিশনে বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের অবাধ যাতায়াত নিশ্চিত করেছেন জিলাল ও তার সহযোগীরা। তাদের মাধ্যমেই জাতীয় দিবসগুলোতে হাইকমিশনে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
৮. অন্যায়, অপকর্ম, ঘুষ, দুর্নীতির প্রতিবাদ করায় ১১ প্রবাসীর বিরুদ্ধে মানবপাচারের অভিযোগ তোলেন জিলাল ও তার সহযোগীরা। পরে তাদের কালো তালিকাভুক্ত করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়।
৯. মতবিরোধ হলেই প্রবাসী শ্রমিকদের মামলার ফাঁদে ফেলে হেনস্তা করেন জিলাল ও তার সহযোগীরা।
১০. বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ ব্রুনাই দারুসসালাম বাংলাদেশের জন্য অন্যতম সম্ভাবনাময় শ্রমবাজার। প্রায় ৩০ হাজার বাংলাদেশি কর্মরত আছেন সেখানে। দেশটিতে আরও বাংলাদেশির কর্মসংস্থান হতে পারে। কিন্তু, জিলাল ও তার সহযোগীদের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না।
জিলালের যত সম্পদ
১. রাজধানীর গুলশান-২ এর ব্লক-ই, ১৯/এ নম্বর রোডে তিন কোটি টাকা দামের ফ্ল্যাট রয়েছে তার।
২. উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর রোডে পাঁচ কাঠার আবাসিক প্লট।
৩. আদাবরের মনসুরাবাদ আবাসিক এলাকায় দু’টি ফ্ল্যাট।
৪. কেরানীগঞ্জের আটি ভাওয়াল স্কুলের পশ্চিম পাশে ৩৮ শতাংশ জমি।
৫. গাজীপুরের কোনাবাড়ির কাশিমপুরে সাড়ে তিন বিঘা জমি।
৬. কালিয়াকৈর পৌর এলাকায় সাড়ে তিন বিঘা জমি।
৭. ফরিদপুরে নামে-বেনামে (পরিবারের সদস্যদের নামে) শত বিঘা জমি।
৮. মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে অ্যাপার্টমেন্ট ব্যবসা।
৯. ব্রুনাইয়ে আদম ব্যবসা।