যাত্রাপুর বাজারের গরু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সীমান্তে নজরদারি বাড়ায় চোরাকারবারিরা রাতের অন্ধকার আর ঘন কুয়াশাকে কাজে লাগিয়ে কলা গাছ ও কাঁশ খড়ের ভেলায় ৮/১০টি করে গরুর পা বেঁধে ভাসিয়ে দিচ্ছে ব্রহ্মপুত্রে।বাংলাদেশ অংশে প্রবেশের পর চোরাকারবারিরা নৌকায় করে গরুগুলো ডাঙায় এনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্রি করছে।
গরু চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, মূলত বিএসএফ গুলি থেকে রক্ষা পেতে তারা এমন কৌশল নিয়েছেন। সাধারণত স্থল কিংবা নৌকায় করে গরু আনতে গেলে বিএসএফ গুলি ছোড়ে। এজন্য ওপার থেকে চোরাকারবারিরা নদীতে গরু ভাসিয়ে দেয়। বিএসএফ মানুষ লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লেও গরুকে গুলি করে না।
যে পথে আসছে ভারতীয় গরুকুড়িগ্রামের সীমান্তবর্তী কয়েকটি উপজেলা দিয়ে ভারতীয় গরু চোরাচালান হলেও বেশির ভাগ আসছে নাগেশ্বরী উপজেলার নারায়ণপুর ও সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের ঝুনকারচর ও রলাকাটার চর সীমান্ত পথে। এছাড়াও উলিপুরের সাহেবের আলগা সীমান্ত পথেও গরু আসে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পানি পথে আসছে গরু।যে কারণে মারা যাচ্ছে গরু বিএসএফ’র চোখ ফাঁকি দিতে এবং বেশি লাভের আশায় চোরাকারবারিরা ব্রহ্মপুত্র নদের প্রবেশ মুখ কালাইয়ের চর উজান থেকে স্রোতে ভাসিয়ে দেওয়া হয় গরু। কয়েকটি গরু একসঙ্গে করে কলা গাছের ভেলা ফাঁকে গরুর মাথা ভাসমান রেখে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। সাঁতার কেটে গরুগুলো যেন ভিন্ন পথে যেতে না পারে সেজন্য তাদের পা বেঁধে দেওয়া হয়। আর মাথার ওপর কাশ কিংবা কচুরিপানা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়, যেন দূর থেকে বোঝা না যায় যে গরুর চালান যাচ্ছে। অতিরিক্ত ঠান্ডায় বা ডুবোচরে অল্প পানিতে আটকা পড়ে কখনও কখনও গরু মারা যায়। ব্রহ্মপুত্র নদের ১০-১২টি ডুবোচরে এমন অর্ধশতাধিক মৃত গরু পড়ে আছে।সরেজমিনে কুড়িগ্রাম সদরের চর যাত্রাপুর, চিরা খাওয়া, ঝুনকার চর, অষ্টআশির চর, রলাকাটার চরসহ বেশকিছু চর ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, নদের দুই পাড়ের এসব ডুবোচরের কোনোটিতে ২০-২৫ টি, কোনোটিতে ১৫-২০ টি, কোনোটিতে এর চেয়েও বেশি মৃত গরু পড়ে আছে। মুচিরা চামড়া নিলেও দেহাবশেষ সেখানেই পড়ে থাকে। সেগুলো পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। ফলে চরাঞ্চলের বাসিন্দরা বিপাকে পড়েছেন। সমস্যায় পড়েছেন নৌপথে চলাচলকারী যাত্রীরা। পাশাপাশি পরিবেশও দূষিত হচ্ছে।চর যাত্রাপুরের নৌকার মাঝি কোবাদ মোল্লা ও শাহ আলম জানান, উজান থেকে পাচার হয়ে আসা অনেক গরু ঠান্ডায় মারা যাচ্ছে। এই মৃত গরুগুলো স্রোতে ভেসে এসে ডুবো চরে আটকা পড়ছে। উজানের চরগুলোতে আরও অসংখ্য মৃত গরু আটকে আছে।চর ভগবতীপুরের জলিল মোল্লা জানান, তার বাড়ির পাশের দু’টি ডুবোচরে প্রায় ২০-২৫টি মৃত গরু পড়ে আছে। গরু পচে পানি যেমন দূষিত হচ্ছে তেমনি দুর্গন্ধে বাড়িতে থাকা যাচ্ছে না। আগে ব্রহ্মপুত্রে গোসলসহ বিভিন্ন কাজ সারলেও এখন পাড়েই আসা যাচ্ছে না। ডুবোচরে আটকে থাকা এসব মৃত গরু পুঁতে না ফেলে নদের পানিতেই ভাসিয়ে দিয়েই প্রশাসন দায় সারছে। শুক্রবার (৩১ জানুয়ারি) চরযাত্রাপুরে গিয়ে দেখা গেছে, ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃক নিয়োজিত কর্মীরা মৃত গরুগুলো ডুবোচর থেকে টেনে নিয়ে স্রোতে ভাসিয়ে দিচ্ছে। ফলে এসব মৃত গরু ভাটির দিকে ভেসে যাচ্ছে। এসব মৃত গরু ভাসিয়ে দেওয়ার ফলে নদীর পানি দূষিত হওয়ার পাশাপাশি পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
যাত্রাপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী সরকার জানান, তার ইউনিয়নের কয়েকটি ডুবো চরে অর্ধশতাধিক মৃত গরু আটকা পড়ে আছে। এসব গরুর কিছু বালুচরে পুঁতে রাখা হলেও বেশিরভাগ গরু ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, শ্রমিকদের দিয়েও এসব মৃত গরু সরানো যাচ্ছে না। দুর্গন্ধে কেউ কাছে যেতে চায় না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কুড়িগ্রাম বিজিবি ২২ ব্যাটালিয়নের পরিচালক লে. কর্নেল মোহাম্মদ জামাল হোসেন বলেন, ‘দু’দেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর কড়া নজরদারির মাঝেও নদী পথে ভিন্ন কৌশলে চোরাকারবারিরা গরু পাচার করায় অনেক গরু মারা যাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা সচেতন রয়েছি।’
জেলা প্রশাসনের উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।