কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র ১০০ ডলার বা ৮ হাজার ৪০০ টাকা (প্রতি ডলার ৮৪ টাকা) বিনিয়োগ করতে এসিআই কোম্পানিকে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিতে হয়েছে। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিয়ে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের প্রতিষ্ঠান স্পেকট্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং সিঙ্গাপুরে সাড়ে ১০ হাজার সিঙ্গাপুরি ডলার (সাড়ে সাত হাজার মার্কিন ডলার) বা ৬ লাখ ৩৬ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেছে। একই খাতের আরেক প্রতিষ্ঠান সার্ভিস ইঞ্জিনিয়ারিং বিদেশে সাড়ে সাত হাজার ডলার বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন পেয়েছে।
জানা গেছে, অনুমতি নিতে গিয়ে অনেককে ভোগান্তির শিকার হতে হয়। অনেক চেষ্টা করেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি পাওয়া যায় না। বাধ্য হয়ে অনেক উদ্যোক্তা অর্থপাচারের পথ বেছে নিচ্ছেন। এতো অল্প পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি কেন নিতে হচ্ছে—এমন প্রশ্নের জবাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেন, বৈধভাবে বা বৈধপথে আয় করা অর্থ ছাড়া অনেক দেশেই টেন্ডারে অংশ নিতে দেওয়া হয় না। এ কারণে উদ্যোক্তারা অল্প পরিমাণ হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিয়ে বিভিন্ন দেশে টেন্ডারে অংশ নেন।
এদিকে, সারাদেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে, যেখানে বিনিয়োগের জন্য সুযোগ-সুবিধা দিয়ে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আহ্বান করা হচ্ছে। মূলধন বিনিয়োগে আগ্রহীদের এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের উন্মুক্ত সুযোগ রয়েছে। এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের ফলে দেশে বিপুল পরিমাণ কর্মসংস্থান সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। একইসঙ্গে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নেরও ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। এ কারণে বিদেশে বিনিয়োগের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক সব সময়ই নিরুৎসাহিত করে আসছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘যেকোনও পরিমাণই হোক না কেন বিনিয়োগ করতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি লাগবে। বিদেশে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে অনেক কিছুই যাচাই-বাছাই করা হয়।’ তিনি বলেন, ‘যদি কেউ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া বিনিয়োগের জন্য বিদেশে অর্থ নিয়ে যায়, তাহলে সেটি হবে মানিলন্ডারিং অপরাধ।’ তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়াই বিদেশে বেড়ানোর জন্য প্রাপ্তবয়স্ক যে কেউ ১২ হাজার ডলার পর্যন্ত সঙ্গে নিতে পারেন বলেও জানান তিনি। বিনিয়োগের ব্যাপারে এতো কড়াকড়ি কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা যেন দেশেই বিনিয়োগ করতে পারে, সেজন্য তাদেরকে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। আর এই মুহূর্তে দেশেই বিনিয়োগ বেশি জরুরি। এ কারণে বিদেশে বিনিয়োগের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক সব সময়ই নিরুৎসাহিত করে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগ থেকে জারি করা এ সংক্রান্ত এক প্রজ্ঞাপন বলা হয়েছে—বিশ্বের যেকোনও দেশে ভ্রমণের সময় প্রাপ্তবয়স্করা (১২ বছরের বেশি) বছরে ১২ হাজার ডলার পর্যন্ত সঙ্গে নিতে পারবে। এর মধ্যে ৫ হাজার ডলার নগদে নেওয়া যাবে। বাকি ৭ হাজার ডলার ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে নিয়ে খরচ করতে পারবে। তবে ১২ বছরের নিচের বাচ্চারাও বছরে পাঁচ হাজার ডলার পর্যন্ত নিতে পারবে।
এদিকে বিদেশে বিনিয়োগ করার ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনও পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা তৈরি হয়নি। ফলে খসড়া তৈরির আগেই বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীকে বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ দিয়েছে। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি না নিয়ে বেশ কয়েকটি গ্রুপ ও প্রতিষ্ঠান বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করেছে। সিঙ্গাপুরের একটি কোম্পানিতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের বিনিয়োগ রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নিয়ম মেনে বিদেশে বিনিয়োগ করা দোষের কিছু নয়। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে যেকোনও দেশ পৃথিবীর যেকোনও দেশে বিনিয়োগ করতে পারে। ১৬০০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমাদের দেশে ব্যবসা করতে এসেছিল। এখনও আমাদের দেশে মাল্টিন্যাশনাল বিভিন্ন কোম্পানি ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা লাভ নিয়ে যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বিদেশে বিনিয়োগ করা দোষের কিছু নয়। যেমন বিদেশিরা আমাদের এখানে বিনিয়োগ করছে, তেমনি আমাদের ব্যবসায়ীরাও বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে। রফতানির বিপরীতে যেভাবে আসে, একইভাবে বিদেশে বিনিয়োগ করেও বৈদেশিক মুদ্রা আসতে পারে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালের পর থেকে এপর্যন্ত সাতটি প্রতিষ্ঠান বিদেশে বিনিয়োগের অনুমোদন পেয়েছে। বিদেশে বিনিয়োগ করা অর্থ থেকে অর্জিত লভ্যাংশ বাংলাদেশে ফেরত আনা, অর্থপাচার না করাসহ বেশকিছু শর্ত দিয়ে দেশি এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিনিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৩ সালে প্রথমবারের মতো মোবিল-যমুনাকে পাঁচ লাখ ১০ হাজার ডলার মিয়ানমারে বিনিয়োগের অনুমতি দেওয়া হয়। সেখানে তারা ‘এমজেএল অ্যান্ড এ কে টি পেট্রোলিয়াম’ নামে একটি কোম্পানি গঠন করে। মোবিল-যমুনা প্রথম বিনিয়োগের সুযোগ পেলেও এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় বিনিয়োগের অনুমতি পেয়েছে তৈরি পোশাক খাতের ডিবিএল গ্রুপ। মোবিল-যমুনা বর্তমানে মিয়ানমার থেকে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে এনেছে। বস্ত্র খাতের শিল্প গ্রুপ দুলাল ব্রাদার্স (ডিবিএল গ্রুপ) আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়ায় তৈরি পোশাক খাতে ৮০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করেছে। কেনিয়ায় ওষুধ কোম্পানি স্থাপনে বিনিয়োগের অনুমতি পেয়েছে ওষুধ খাতের অন্যতম প্রধান কোম্পানি স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস। মালয়েশিয়ায় স্থাপিত শিল্পপ্রতিষ্ঠান অধিগ্রহণের জন্য আকিজ গ্রুপকে ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের অনুমতি দিয়েছে সরকার। ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস যুক্তরাজ্যে ১০ হাজার স্টারলিং (১৩ হাজার ডলারের বেশি) বিনিয়োগ করছে। ২০১৪ সালে এস্তোনিয়ায় বিনিয়োগের অনুমতি পায় ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস। যুক্তরাজ্যেও ১০ হাজার ব্রিটিশ পাউন্ড বিনিয়োগে একটি নিজস্ব সাবসিডিয়ারি খুলেছে কোম্পানিটি। আফ্রিকার দেশ কেনিয়ায় ইস্পাত কারখানা খোলার অনুমতি পেয়েছে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম স্টিল। প্রতিষ্ঠানটিকে শর্ত সাপেক্ষে রফতানি প্রত্যাবাসন কোটা (ইআরকিউ) থেকে ৪৬ লাখ ৭০ হাজার ডলার কেনিয়ায় বিনিয়োগের অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।