ঢাকার শব্দ দূষণের অন্যতম ভুক্তভোগী ট্রাফিক পুলিশ। জনবহুল এবং ব্যস্ত সড়কে যারা দায়িত্ব পালন করেন তাদের মধ্যে শতকরা ১৫ জনই কানে কম শুনছেন, চোখেও কম দেখছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শব্দদূষণে আক্রান্ত হয়েই তারা এসব সমস্যায় ভুগছেন।
সোমবার বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে আলাপে জানা গেছে- ফার্মগেট, বিজয় সরণি, জাহাঙ্গীর গেট, মহাখালী, নাবিস্কো, তিব্বত, সাতরাস্তার মোড়, মগবাজার, কারওয়ান বাজার, বাংলামোটর, শাহবাগ, পল্টন, গুলিস্তান, মতিঝিল, রাজারবাগ, মিরপুর, সায়েদাবাদসহ ব্যস্ত সড়কের দায়িত্ব থাকা বেশিরভাগ ট্রাফিক পুলিশ কানে কম শোনেন।
এসব রাস্তায় সব ধরনের যান বাহন চলাচল করে। গাড়ির হর্ন বা শব্দে কান ঝালাপালা হওয়ার উপক্রম। সিগন্যাল পড়লেই শুরু হয় এলোমেলো হর্ন বাজানোর প্রতিযোগিতা। বিকট আওয়াজের হর্ন সহ্য করে যানবাহন সামলাতে গলদঘর্ম হতে হয় ট্রাফিক পুলিশকে। কোনো কোনো পয়েন্টে পুলিশ বক্সও নেই। সেসব স্থানে দায়িত্ব পালনকারীদের বিশ্রামও নিতে হয় রাস্তায়।
বিজয় স্মরণীর দায়িত্বে থাকা সার্জেন্ট মাজেদ বলেন, ‘গাড়ির হর্নের শব্দেই আমরা কাহিল হয়ে যাই। মাথাব্যথা করে। ঠিকমতো ঘুম হয় না। আগের তুলনায় এখন কানেও অনেক কম শুনি।’
ফার্মগেট মোড়ে দায়িত্বরত ট্রাফিক সার্জেন্ট আহাদ বলেন, ‘থানায় প্রায় ২৪ ঘণ্টা ডিউটি করতে হয়। এজন্য ট্রাফিকে পোস্টিং নিই। কিন্তু এখানে এসে মনে হচ্ছে ভুলই করেছি। কানেতো কম শুনছিই, চোখেও ঝাপসা দেখছি ইদানিং। গত ৬ মাসে কী পরিমাণ যে ধুলা খেয়েছি, তার কোনো হিসেব নেই। প্রায়ই পুলিশ হাসপাতালের ডাক্তারের কাছে যেতে হয়।’
গুলিস্তানের ট্রাফিক ইদ্রিস আলী বলেন, ‘বাসায় গিয়ে টিভি দেখতে বসলে ভলিউম বাড়িয়ে দিয়ে হয়। কেননা কানে কম শুনি। অথচ একই ভলিউমে পরিবারের অন্যদের কাছে বেশি হয়ে যায়।’
শুধু এরাই নয়, রাজধানী ঢাকার বেশিরভাগ ট্রাফিক পুলিশ সদস্যের একই ধরনের সমস্যা।
এ বিষয়ে সোমবার বিকেলে কথা হয় ট্রাফিক পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মফিদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘চাকরি করতে আসলে অনেক কিছু স্যাক্রিফাইস করতে হয়। তারপরও যেসব ট্রাফিক পুলিশের শারীরিক সমস্যা হয়, সাধ্যমতো তাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। কারো বেশি সমস্যা হলে তাকে অন্যত্র বদলি করে দেওয়া হয়। রাস্তায় দায়িত্বপালন করলে শুধু কানই নয়, শরীরের অন্য সমস্যা দেখা দেওয়াও স্বাভাবিক।’
নাক-কান ও গলা বিশেষজ্ঞ প্রাণ গোপাল দত্ত বলেন, “শব্দদূষণে আক্রান্তরা কানে কম শোনেন। কানে শোঁ শোঁ শব্দ হয়। উচ্চরক্তচাপও দেখা দেয়। এক সময় কানে একেবারে শুনতে না পাওয়ারও সম্ভাবনা থেকে যায়। এ কারণে কয়েকদিন পর পর তাদের চিকিৎসা করানো উচিত।
‘যারা টানা ৮ ঘণ্টার বেশি সময় কাজ করেন অথচ ১২ ঘণ্টার বেশি সময় বিশ্রাম পান না, তাদের কানের ক্ষতি বেশি হবে। এ কারণে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের কানের সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।”
ঢাকা মহানগরীতে কর্মরত ৩৫- ৬০ বছর বয়সী ১০০ জন রাস্তায় ডিউটি করেন এমন ট্রাফিক পুলিশ সদস্যের ওপর এ গবেষণা চালানো হয়। গবেষণায় উঠে এসেছে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের শ্রবণশক্তি দিন দিন লোপ পাচ্ছে। রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে সপ্তাহে দুই দিন উন্নতমানের মেশিন দিয়ে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের কান পরীক্ষা করা হয়। সেখানেও তাদের শ্রবণ শক্তি লোপ পাওয়ার বিষয়টি পরিস্কার ধরা পড়েছে। বিষয়টি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে বলে দায়িত্বে থাকা এক চিকিৎসক জানান।
কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিভিন্ন রোগীর মধ্যে দিনে কম করে হলেও ৫৫ জন কানের রোগী সেখান থেকে চিকিৎসা নেন। এর মধ্যে ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা গড়ে ৩০ জনের মতো হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্যমতে, ৮৫ ডেসিবল মাত্রার শব্দ টানা আট ঘণ্টা শুনলে অথবা ১০০ ডেসিবল মাত্রার শব্দ ১৫ মিনিট শুনলেই শ্রবণশক্তি ক্ষতির শিকার হবে যেকোনো মানুষ।