সূত্র জানায়, হযরত শাহাজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দেশি-বিদেশি ৩৯টি এয়ারলাইন্সের দিনে গড়ে ২৫০টি ফ্লাইট ওঠা-নামা করে। বছরে ৮০ লাখের বেশি যাত্রী ব্যবহার করে এই বিমানবন্দর। এই বিপুল পরিমাণ যাত্রী চলাচলের অনুপাতে বিমানবন্দরের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জনবল অপ্রতুল। ২৪ ঘণ্টা কার্যক্রম চালাতে যে জনবল প্রয়োজন, তা না থাকায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থার নির্ধারিত মানদণ্ড অনুসরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। একইসঙ্গে যে পরিমাণ জনবল আছে, তারাও যথাযথ প্রশিক্ষিত নন। ইসিজি মেশিন, সাকার মেশিন, নেবুলাইজার মেশিন, অটোক্লেব মেশিনসহ অন্যান্য যন্ত্র থাকলেও এগুলোর পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কেউ নেই। হাসপাতালগুলোয় এসব যন্ত্র পরিচালনার জন্য আলাদাভাবে টেকনোলজিস্ট পদে জনবল থাকে। তবে, বিমানবন্দরে এসব পদ না থাকায় চিকিৎসক ও নার্সদের এই বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। অন্যদিকে কোনও রোগীকে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে পরবর্তী চিকিৎসার জন্য কুর্মিটোলা হাসপাতালে পাঠানো হয় অ্যাম্বুলেন্সে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জনবল না থাকায় শুধু অ্যাম্বুলেন্স চালক ছাড়া গাড়িতে রোগীর সঙ্গে কেউ থাকে না।
আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী, বিমানবন্দর স্বাস্থ্যকেন্দ্র হতে হবে দৃশ্যমান ও বহিগর্মনের সুবিধা রয়েছে এমন স্থানে। যেন যেকোনও যাত্রী শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে নিজেই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে পারেন। একইসঙ্গে কোনও রোগীকে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার জন্য বহিগর্মনের সুবিধা রয়েছে এমন স্থানে স্থাপনের বিধান রয়েছে। তবে, এই দু’টি নিয়মের কোনোটিই অনুসরণ হচ্ছে না শাহজালালের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ক্ষেত্রে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবনের দক্ষিণ পাশে প্রথম তলা ও দ্বিতীয় তলার কয়েকটি কক্ষে পরিচালিত হচ্ছে বিমানবন্দর স্বাস্থ্যকেন্দ্র। দ্বিতীয় তলার রুমগুলো বহির্গমন কনকোস হলের পাশে খানিকটা দৃশ্যমান হলেও নিচতলায় যাত্রীদের নজরের বাইরে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের রুমগুলো। প্রতিটি রুম আয়তনে খুব ছোট। রোগীকে চিকিৎসা দিতে একই রুমে চিকিৎসক, নার্স দাঁড়ানোর জায়গাও নেই। জায়গা না থাকায় স্বাস্থ্যকেন্দ্রের রেফ্রিজারেটরসহ অন্য যন্ত্রপাতি রুমের বাইরে খোলা স্থানে রাখতে হয়। নিচ তলায় স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দরজার পাশে ফেলে রাখা হয়েছে পরিত্যক্ত আসবাবপত্র। ইসিজি মেশিন, সাকার মেশিন, নেবুলাইজার মেশিন, অটোক্লেব মেশিন থাকলেও জায়গার সংকটে ব্যবহার হচ্ছে না। কারণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের রুমগুলো আয়তনে ছোট হওয়ায় রোগীর বেড, চিকিৎসক ও যন্ত্রপাতি একই কক্ষে রাখার মতো স্থান নেই। বর্তমানে জরুরি রোগী এলে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের খোলা জায়গায় বেড নিয়ে যন্ত্রপাতির মাধ্যমে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র রাখার বিধান রয়েছে। একইসঙ্গে সেই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সঙ্গে নিকটবর্তী যেকোনও জেনারেল হাসতাপালের সঙ্গে সমঝোতা থাকতে হবে। যেন বিমানবন্দর স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে দ্রুত সময়ে কোনও রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা যায়। বর্তমানে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সঙ্গে কুর্মিটোলা জেনারেল থাসপাতালের মধ্যে এমইউ রয়েছে। তবে হৃদরোগ আক্রান্তদের আসার সংখ্যা বেশি হওয়ায় যেকোনও হৃদরোগ হাসপাতালের সঙ্গেও সমঝোতা থাকা জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। যেন কুর্মিটোলার পরিবর্তে দ্রুত সময়ে সরাসরি হৃদরোগ হাসপাতালে স্থানান্তর করা যায়।
সূত্র জানায়, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সব চেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে যাত্রীদের মধ্য থেকে সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্তদের শনাক্তকরণ কার্যক্রম। বিদেশে থেকে আসা যাত্রীদের মধ্যে কেউ সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত কিনা, তা শনাক্ত করতে রয়েছে তিনটি থার্মাল স্ক্যানার। এ থার্মাল স্ক্যানার মেশিনের মাধ্যমে দেহের উত্তাপ মাপার মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে কেউ আক্রান্ত কিনা, তা শনাক্ত করা হয়। তবে ৩টি মেশিন থাকলেও একটি মেশিন প্রায় সময়ে বিকল হয়ে যায়। জিকা, ইবোলা ও নিপাহসহ বেশকিছু সংক্রামক ব্যাধি ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও প্রাথমিক লক্ষণ জ্বর। আর এ কারণে যাত্রীদের শরীরের তাপমাত্রা পরিমাপের জন্য থার্মাল স্ক্যানার জরুরি। নিয়ম অনুযায়ী শুধু উপসর্গ দেখে ইবোলা সংক্রমণ নিশ্চিত করা যায় না। প্রাথমিকভাবে শনাক্ত আক্রান্তদের শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষাগারে শনাক্ত করতে হয়। এ সময়ে শনাক্ত হওয়া ব্যক্তিকে আইসুলেশনের মধ্যে রাখতে হয়।
সূত্র জানায়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুসারে থার্মাল স্ক্যানার মেশিনের প্রাথমিকভাবে শনাক্ত ব্যক্তিকে কোয়ারেন্টাইন হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হবে। এজন্য বিমানবন্দরের কাছাকাছি কোয়ারেন্টাইন হাসপাতাল থাকতে হবে অথবা বিমানবন্দরে কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা থাকতে হবে। শাহজালাল বিমানবন্দরে হ্যাঙ্গার গেটের কাছে একটি ভবনে কোয়ারেন্টাইন হাসপাতাল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ভবনটি র্যাপিড একশন ব্যাটিলিয়ন (র্যাব)-কে তাদের সদর দফতর হিসেবে ব্যবহার করতে দেওয়ায় এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়নি। পরে নিয়ম রক্ষার জন্য টার্মিনাল ভবনের নিচ তলার একটি রুমে নিয়ম না মেনে কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিয়ম অনুসায়ী সন্দেহভাজন আক্রান্ত ব্যক্তিকে শতভাগ নিশ্চিত না হওয়ার আগ পর্যন্ত অন্য সব মানুষের কাছ থেকে দূরে রাখতে হয়। নির্দিষ্ট স্থানেই সে ব্যক্তির খাওয়া, ঘুম, মলমূত্র ত্যাগের ব্যবস্থা থাকবে। এমনকি সুরক্ষার জন্য চিকিৎসদেরও বিশেষ পোশাক পরতে হবে। শাহজালাল বিমানবন্দরের কোয়ারেন্টাইন রুমে রোগীর খাওয়া ও মল-মূত্র ত্যাগের কোনও ব্যবস্থা নেই, সাধারণ যাত্রীদের টয়লেটই ভরসা। এমনকি বিমানবন্দরের থেকে রোগীকে সাধারণ যাত্রীদের সংস্পর্শ না এনে হাসপাতালে নিতে পৃথক গেট রাখার ব্যবস্থার নিয়ম থাকলেও তা নেই শাহজালাল বিমানবন্দরে।
অন্যদিকে, আফ্রিকাসহ যেসব দেশে প্রাণঘাতী সংক্রামব্যাধির প্রকোপ বেশি সেদেশ থেকে ফ্লাইট আসার আগাম তথ্য জানানো হয় না স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে। ফলে অগ্রিম প্রস্তুতি নিতে না পারছে না স্বাস্থ্যকেন্দ্র।
নিয়মিত স্বাস্থ্য বিষয়ক মহড়ার বিধান থাকলে তা পালন করা হয় না। গত ২১ অক্টোবর ঢাকায় ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইকাও) কোলাবেরেশন অ্যারেঞ্জমেন্ট ফর দ্য প্রিভেনশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অব পাবলিক হেলথ ইভেন্টস ইন সিভিল এভিয়েশন-এশিয়া প্যাসেফিক (সিএপিএসসিএ-এপি) এর ১১তম সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সময় প্রথমবারের মতো শাহজালালে পাবলিক হেলথ বিষয়ক মহড়াও অনুষ্ঠিত হয়।
বিমানবন্দরের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ শাহরিয়ার সাজ্জাদ বলেন, ‘আমরা কেউই প্রত্যাশা করি না, আমাদের দেশে ভয়াবহ সংক্রামব্যাধি নিয়ে কেউ আসুক ও তা ছড়িয়ে পড়ুক। কিন্তু এ বিষয়টি মোকাবিলার জন্য আমাদের সব সময় প্রস্তুত থাকতে হবে। বর্তমানে আমাদের বড় সংকট হচ্ছে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকা। এছাড়া, জনবল বাড়ানো প্রয়াজন। সামগ্রিক বিষয় নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সিভিল অ্যাভিয়েশন অথরিটিকে জানানো হয়েছে।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান বলেন, ‘বিমানবন্দরের স্বাস্থ্যকেন্দ্র আগের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত করা হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অনেক আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়েছে। মূলত আমাদের এখানে কাজ হচ্ছে মনিটরিং করা। যেন আক্রান্ত কোনও ব্যক্তি দেশে চলে না আসতে পার। হেলথ অ্যালার্ট থাকলে মনিটরিং আরও বেড়ে যায়। আপতত দৃষ্টিতে আমাদের বিমানবন্দর স্বাস্থ্যকেন্দ্র বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় খারাপ নেই।’ ভবিষতে আরও উন্নয়ন করা হবে বলেও তিনি জানান।