কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা এবং শ্রমিকের মৃত্যু প্রতি বছরের মতো এবারও ঘটেছে। ডিসেম্বর মাসেই ঘটেছে বেশ কিছু দুর্ঘটনা। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের ওপর পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, গত এক বছরে (জানুয়ারি-ডিসেম্বর ২০১৯) সারাদেশে ৪২৩টি কর্মক্ষেত্র দুর্ঘটনায় ৫৭২ জন শ্রমিক নিহত হয়েছে। ২০১৮ সালে ৪৮৪টি কর্মক্ষেত্র দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিল ৫৯২ জন শ্রমিক।
বেসরকারি সংস্থা সেইফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটি ২৬টি দৈনিক সংবাদপত্র (১৫টি জাতীয় এবং ১১টি স্থানীয়) মনিটরিং করে বছর শেষে মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে। যেসব শ্রমিক কর্মক্ষেত্রের বাইরে অথবা কর্মক্ষেত্র থেকে আসা-যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় তাদেরকে এই জরিপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
জরিপে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি শ্রমিক নিহত হয়েছে পরিবহন খাতে। যাদের সংখ্যা মোট ২১২ জন। এর পরেই রয়েছে নির্মাণ খাত। এই খাতে নিহত হয়েছে ১২৯ জন। সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে (যেমন ওয়ার্কশপ, গ্যাস, বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি) ১০২ জন, কল-কারখানা ও অন্যান্য উৎপাদনশীল প্রতিষ্ঠানে ১০০ জন এবং কৃষি খাতে এই সংখ্যা ২৯ জন।
মৃত্যুর কারণ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় ২১৮ জন, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ৬৭ জন; আগুনে পুড়ে ৬৭ জন; ছাদ, মাঁচা বা ওপর থেকে পড়ে মারা গেছে ৫৪ জন; শক্ত বা ভারী কোনো বস্তুর দ্বারা আঘাত বা তার নিচে চাপা পড়ে ৪৫ জন; ব্রিজ, ভবন, ছাদ, মাটি ও দেয়াল ধসে ২৮ জন; রাসায়নিক দ্রব্য বা সেপটিক ট্যাঙ্ক বা পানির ট্যাঙ্কের বিষাক্ত গ্যাসে আক্রান্ত হয়ে ২৫ জন; বজ্রপাতে ২৫ জন; পানিতে ডুবে ২০ জন; বিভিন্ন বিস্ফোরণে ১৭ জন এবং অন্যান্য কারণে ছয়জন শ্রমিক নিহত হয়েছে।
সেইফটি অ্যান্ড রাইটসের নির্বাহী পরিচালক সেকেন্দার আলী মিনা বলেন, প্রতি বছর নিরাপত্তা সম্পর্কিত সচেতনতার অভাবে দেশে কর্মক্ষেত্র দুর্ঘটনায় অনেক শ্রমিক মারা যাচ্ছে। আমরা কর্মক্ষেত্র দুর্ঘটনার সংখ্যা কমিয়ে আনার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করি, কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন ঘটে না। সেইফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটি একটি অধিকার রক্ষাকারী সংগঠন হিসেবে প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে কর্মক্ষেত্র দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সমগ্র জনগোষ্ঠীর তুলনায় এসব প্রচেষ্টা খুব তাৎপর্যপূর্ণ নয়। সুতরাং সেইফটি অ্যান্ড রাইটস বিশ্বাস করে একমাত্র সবার যৌথ প্রচেষ্টাই পারে কর্মক্ষেত্র দুর্ঘটনা থেকে শ্রমিকের জীবন বাঁচাতে।
তিনি বলেন, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রধান দায়িত্ব মালিকের। আর সরকার এ সংক্রান্ত আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করবে এবং মালিক কর্তৃক গৃহীত কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ব্যবস্থা মনিটরিং করবে।
সেকেন্দার আলী মিনা বলেন, অনিয়ন্ত্রিত পরিবহন ব্যবস্থা, আইন প্রয়োগে বাধা ইত্যাদির কারণে দুর্ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে। তাছাড়া যত্রতত্র কলকারখানা গড়ে উঠায় দুর্ঘটনায় শুধু শ্রমিক নয় সাধারণ জনগণও আক্রান্ত হচ্ছে। এসব দুর্ঘটনা প্রতিহত করায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে।
জরিপের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, অধিকাংশ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার ঘটনা ঘটে নিরাপত্তা সামগ্রী ব্যবহার না করে বৈদ্যুতিক লাইন সংযোগ দেয়ার সময়, মটর চালু করতে গিয়ে, মাথার ওপরে বয়ে যাওয়া বিদ্যুতের লাইনের নিচে কাজ করতে গিয়ে বা নির্মাণ সাইটে লোহার রড নিয়ে কাজ করার সময় শক্তিশালী বিদ্যুতের লাইন লোহার রড স্পর্শ করার ফলে। নির্মাণাধীন ভবনের পাশে বেড়া বা গার্ড তৈরি না করার ফলে লোহার রড বিদ্যুতের সংস্পর্শে আসে।
রিপোর্টে বলা হয়, নিয়মানুযায়ী যথাযথভাবে মাচা তৈরি না করার ফলে মাচা ভেঙে বা মাচা থেকে পড়ে প্রায়ই শ্রমিক নিহত হচ্ছে। এছাড়া, অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রপাতির অপ্রতুলতা বা যথাযথ অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতি না থাকা বা নিয়মিত মহড়া না দেয়া বা বিকল্প বহির্গমনের ব্যবস্থা না থাকার ফলে অগ্নিকাণ্ডে শ্রমিক মারা যায়।
কর্মক্ষেত্র দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কিছু সুপারিশ
কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সংস্থাটি কিছু সুপারিশ দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে হাইকোর্টের রায় (চূড়ান্ত রায় ০২-১১-২০১১) মেনে কোড এনফোর্সমেন্ট অথরিটি গঠন করে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড, ২০০৬ যথাযথ বাস্তবায়ন করা। এছাড়া আইন বাস্তবায়নে রাজউক ও কল-কারখানা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরসহ অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্য নীতি প্রণয়ন করা, নির্মাণ কাজ শুরুর পূর্বে নিরাপত্তা পরিকল্পনা প্রণয়ন ও অনুসরণ করা, বিনামূল্যে কর্মরত শ্রমিকদের যথাযথ ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সরঞ্জাম প্রদান করা, পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান এবং যথাযথভাবে প্রযু্ক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা।