মানসিক চাপে ভোগেন প্রবাসী কর্মীরা
দিনে ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস, দীর্ঘদিন স্বজনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা এবং ধার করে বিদেশ যাওয়ায় টাকা উপার্জনে মানসিক চাপে ভোগেন প্রবাসী কর্মীরা। প্রবাসীদের এমন অকালমৃত্যুর কারণ নিয়ে এখনও কোনও অনুসন্ধান হয়নি। প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো মৃত্যুর এই সংখ্যা নিয়ে উদ্বিগ্ন। গত চার বছরে যত প্রবাসীর লাশ এসেছে, তাদের মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অন্তত ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রেই মৃত্যু হয়েছে আকস্মিকভাবে। তাদের বয়স ২৮ থেকে ৪০ এর মধ্যে।
প্রবাসী কর্মীর অকাল মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেন, মানুষ মারা যাবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু অল্প বয়সে, মধ্যবয়সে কিংবা অকাল মৃত্যু উদ্বেগের। তরুণ বয়সে যারা মৃত্যুবরণ করছেন তাদের নিয়ে আমাদের মধ্যেও উদ্বেগ আছে। বিদেশের আবহাওয়া কিংবা পরিবেশ গ্রীষ্মকালে ৪০ থেকে ৫০ ডিগ্রি পর্যন্ত বেড়ে যায়। সে হিসেবে অনেকে হিট স্ট্রোকেও মারা যায়। যার জন্য কয়েকদিন আগে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের সঙ্গে আমাদের মিটিং ছিল। সেখানে এই মৃত্যুর বিষয়ে আমি আলোচনা করেছিলাম। তারা আমাদের পরামর্শ দিয়েছেন, যারা বিদেশে যায় তাদের যেন আমরা কিছুটা ব্রিফিং দেই- কীভাবে চলতে হবে, কীভাবে থাকতে হবে, পানি বেশি খেতে হবে এসব বিষয়ে।
তিনি বলেন, হার্ট ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় নানারকম পরামর্শ সম্বলিত একটি প্যামপ্লেট বানিয়েছি। যখন প্রাক বহির্গমন ট্রেনিং দেই তখন এটাও একটা করে দেবো যাতে তারা সাবধানতা অবলম্বন করতে পারেন। অকালমৃত্যু কিংবা অস্বাভাবিক মৃত্যু আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য না। এছাড়া আত্মহত্যার বিষয়টি নিয়ে আমাদের বিরাট প্রশ্ন আছে। আমরা সৌদি সরকারের কাছে তাদের তথ্য দিয়েছি। তারা অবশ্যই তদন্ত করবে বিষয়টি।
গন্তব্য দেশের আবহাওয়া সম্পর্কে ধারণা দরকার
প্রবাসী কর্মীদের অকাল মৃত্যু কমাতে গন্তব্য দেশের আবহাওয়া, খাবার ও সংস্কৃতি সম্পর্কে শ্রমিকদের আগেই ধারণা দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা। ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, সৌদি আরবের তাপমাত্রা অনেক বেশি, কখনও ৫০ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠে। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে, কতটুকু মাংস খাবে, কতটুকু পানি খাবে, ধুমপানে বিধিনিষেধ সম্পর্কে তাদের ধারণা দেওয়া হয় না। সে দেশে মাংস খুব সস্তা, সিগারেটও অনেক কম দামে পাওয়া যায়।
কিনি বলেন, এই মৃত্যুর সঙ্গে আবার উচ্চ অভিবাসন ব্যয় জড়িত আছে। একজন কর্মী যখন অনেক টাকা খরচ করে যান তার সবসময় টেনশন থাকে এই টাকা তুলে আনার। এই টাকা তোলার জন্য তিনি মরিয়া হয়ে থাকেন। ১৮ ঘণ্টা থেকে ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করেন। এক রুমের মধ্যে গাদাগাদি করে থাকেন, অতিরিক্ত টাকা কামাইয়ের জন্য অবৈধ হয়ে যান। অবৈধ হয়ে গেলে পরে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন না। তিনি বলেন, আমাদের কিন্তু ৬১ শতাংশ লাশ আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে যার মধ্যে ৩১ শতাংশ সৌদি আরবের।
কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি
বেসরকারি সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) গবেষক ড. জালাল উদ্দিন শিকদার বলেন, গার্মেন্টসের বাইরে অন্যান্য খাত যেমন কন্সট্রাকশন খাতে যারা কাজ করতে যান, তাদের কী শুধু বেতন নিশ্চিত করেই শেষ? তাদের বিনোদনের সুযোগ কোথায়? যেখানে আমাদের কর্মীরা হাসি-খুশি আনন্দ নিয়ে কাজ করবেন সে রকম একটা পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি বলে আমি মনে করি। এছাড়া স্বাস্থ্য পরীক্ষার সময় বিদেশগামী কর্মী মানসিকভাবে প্রস্তুত কিনা তা যাচাই করা দরকার।
বিদেশ যাওয়ার সময় বিমানবন্দরে প্রবাসীদের পুনরায় স্বাস্থ্য পরীক্ষার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, যারা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এবং অভিবাসনের প্রয়োজন রয়েছে এ রকম লোকজনকে বিদেশে পাঠানো উচিত। কারণ একজন কর্মী বিদেশ যাওয়ার সময় প্রচুর স্ট্রেস (মানসিক চাপ) নিয়ে যান। দেখা যায় যে, শারীরিকভাবে শক্ত না এবং অনেক টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশ যাচ্ছেন অনেকে। এই অবস্থায় যখন উষ্ণ মরুর দেশে যান তখন তারা একটা বড় ঝুঁকিতে থাকেন।