রাজধানীর বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারগুলোতে এখন হরেক পদের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। দেশি-বিদেশি পুরনো পেঁয়াজের পাশাপাশি নতুন পেঁয়াজ, এর ফুল ও পাতায় এখন বাজার ভরপুর। ক্রেতারা বলছেন, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কারসাজি করে পচনশীল এই পণ্যটির দাম বাড়ানোর যে খেলা চলছিল সে খেলা বন্ধে এখন বাধ্য হচ্ছে আড়তদার-আমদানিকারক ও পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা। বছরের এই সময়ে পেঁয়াজের দাম স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি থাকায় নতুন ওঠা পেঁয়াজেরও গত দুই সপ্তাহে দাম ছিল আকাশচুম্বী। তবে প্রতিদিনই সরবরাহ বাড়ায় নতুন-পুরনো সব ধরনের পেঁয়াজেরই দাম কমাতে বাধ্য হচ্ছেন বিক্রেতারা। এতে হাফ ছেড়ে বাঁচছেন তারা।
আর বিক্রেতারাও বলছেন, নতুন পেঁয়াজ উঠতে শুরু করায় দাম এখন অনেক কম। তাই আমরাও স্বস্তি অনুভব করছি।
রাজধানীর বাজার গুলোয় এখন আর সেভাবে পুরান দেশি পেঁয়াজ নাই। যা আছে তা অনেকটা দেশি পেঁয়াজের মতো মনে হলেও তা আসলে মিয়ানমারের পেঁয়াজ। দেশি পুরান পেঁয়াজ নয়। তবে এতেও সুযোগ বুঝে প্রতারণা চলছে ক্রেতাদের সঙ্গে। পুরান পেঁয়াজ বলে গজ (বীজ) বেরিয়েছে এমন কথা বলে বিক্রেতারা মিয়ানমারের এসব পেঁয়াজকে দেশি পেঁয়াজ হিসেবে বেশি দামে চালিয়ে দিচ্ছেন। যারা পেঁয়াজের আকার ও রঙের তফাত বুঝতে পারেন না তারাই এসব ক্ষেত্রে প্রতারিত হচ্ছেন বেশি।
বাজার ঘুরে দাম-দর যা জানা গেছে তাতে গজ ওঠা মিয়ানমারের এসব পেঁয়াজ বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে। এক সপ্তাহ আগে এই পেঁয়াজের দর ছিল ২০০ থেকে ২২০ টাকা কেজি।
রাজধানীর কাওরানবাজার, কোনাপাড়া বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে মিসরের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজি দরে। আমদানি করা চীনের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা কেজি দরে। অনলাইনের কেনাকাটার সাইটে এই পেঁয়াজ ৪৯ টাকা দরেও বিক্রি করার তথ্য পাওয়া গেছে। যদিও এর সঙ্গে পৌঁছে দেওয়ার খরচ যোগ করলে তা ৬০ টাকা কেজি দরেই পড়ে যায়। বাজার ঘুরে আরও দেখা গেছে, ফরিদপুরের মুড়ি কাটা পেঁয়াজ নামে পরিচিত দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা কেজি দরে। পেঁয়াজের ফুল অর্থাৎ পেঁয়াজের কালি বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৮০ টাকা কেজি দরে। একই দামে বিক্রি হচ্ছে পেঁয়াজসহ পেঁয়াজের পাতা। মানুষ তা কিনছেন বেশ আগ্রহ ভরে।
জানতে চাইলে কোনাপাড়া বাজারের সবজি বিক্রেতা মাছুম মিয়া জানিয়েছেন, পেঁয়াজের পাতা ও পেয়াজের কালি বিক্রি হচ্ছে বেশ। ৬০ থেকে ৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছি। মানুষ বেশ পছন্দ করেই কিনছেন। পেঁয়াজের দামবেশি ছিল বলে অনেকেই এগুলো দিয়ে পেঁয়াজের চাহিদা মিটিয়েছেন। বাজারে এখন নতুন পুরান সব পেঁয়াজই রয়েছে। দামও কমছে। তাই ক্রেতারা এখন আর বাজারে পেঁয়াজ কিনতে এসে আগের মতো হা পিত্যেস করছেন না।
শ্যামবাজারের পেঁয়াজ আমদানিকারক লাল বিহারী জানিয়েছেন, মিসর, ও চীন থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ এখনও প্রচুর পরিমাণে আছে। যে দামে কিনেছি সেই দাম এখন আর পাচ্ছি না। বাজারে নতুন পেঁয়াজ উঠতে শুরু করায় দাম কমে গেছে। তারপরেও বিক্রি করছি। কারণ, কিছুদিন পর যখন দেশি পেঁয়াজে বাজার ভরে যাবে তখন তো আর এই পেঁয়াজ কেউ কিনবেন না। তাই বড় ধরনের লোকসান ঠেকাতে কম লোকসানে পণ্য বিক্রি করছি।
জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব ড. জাফর উদ্দিন জানিয়েছেন, সংকট মোকাবিলায় সরকারের জরুরি পদক্ষেপ হিসেবে বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন পথে আমদানি করা পেঁয়াজ বাজারে সরবরাহ বাড়িয়েছে। যা দামের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। অপরদিকে নতুন পেঁয়াজও উঠতে শুরু করায় দাম কমছে। তাই জনজীবনে স্বস্তি ফিরছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজধানীর রায়েরবাগ এলাকার মুসলিম নগরের বাসিন্দা নির্মাণ শ্রমিক লোকমান জানিয়েছেন, অনেক কষ্ট করেছি। পেঁয়াজ ছাড়া রান্না করা তরকারি খেয়েছি। সেই সব দিনের কথা মনে করতে চাই না। বাজারে পেঁয়াজের পাতা আছে, পেয়াজের কালি (ফুলকা) আছে। নতুন পেঁয়াজ উঠছে। তাই যখন যেটা সাধ্যে কুলায় সেটাই কিনি।
উল্লেখ্য, ২৯ সেপ্টেম্বর ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক বাণিজ্য শাখার বরাত দিয়ে জানানো হয়, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ থাকবে। এই সিদ্ধান্তের প্রভাব পড়েছে দেশীয় পেঁয়াজের বাজারে। আর এর সুযোগ নেয় পেঁয়াজের আমদানিকারক, আড়তদার, পাইকার ও ব্যবসায়ীরা। সংকটের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তারা পেঁয়াজের দাম বাড়াতে শুরু করে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম পেঁয়াজের কেজি ২৬০ থেকে ২৭০ টাকা পর্যন্ত ওঠে। বিভিন্ন দেশ থেকে প্রয়োজনের চেয়েও বেশি পরিমাণে পেঁয়াজ আমদানি করলেও এই সংকট সামাল দিতে পারেনি সরকার। বিশেষ করে আমদানি না হলেও সংকটের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দেশি পেঁয়াজের দাম আকাশচুম্বী হওয়াটা ছিল সবচেয়ে রহস্যজনক। এরইমধ্যে একদিন লবণের দামেও কারসাজির চেষ্টা করা হলেও সেটি ঠেকিয়ে দেয় সরকার। কিন্তু পেঁয়াজের গায়ে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য না থাকায় এর মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনও প্রচেষ্টাই কাজে আসেনি। সাধারণ মানুষের অভিযোগ, সরকারের মন্ত্রী ও কর্মকর্তারা পেঁয়াজ ইস্যুতে মুখে যত কথা বলেছেন বাজার নিয়ন্ত্রণে সমাধানের উপায় বের করার ক্ষেত্রে ছিলেন ততটাই ব্যর্থ। তবে সব সংকট সমাধানে সবার চোখ ছিল নতুন পেঁয়াজ ওঠার দিকে। শেষ অবধি নতুন পেঁয়াজ বাজারে ওঠার পর থেকেই পেঁয়াজের দর কমছে যদিও তা স্বাভাবিক সময়ের দামের চেয়ে এখনও অনেক গুণ বেশি।
বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের তথ্য মতে দেশে পেঁয়াজের বাৎসরিক চাহিদা ২৪ লাখ মেট্রিক টন। ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ২৩ লাখ ৩৪ হাজার মেট্রিক টন। পেঁয়াজ পচনশীল বলে সংস্থাটির ধারণা, বছরে উৎপাদিত পেঁয়াজের ৩০ শতাংশ অর্থাৎ সাড়ে সাত লাখ টন পচে যায়। এটাই ঘাটতি। এই ঘাটতি মেটাতে সাধারণত বছরে আমদানি করা হয় ৮ থেকে ১০ লাখ টন পেঁয়াজ।