নিজস্ব প্রতিবেদক:
রাজধানীর মানুষ নানা দুর্ভোগ নিয়ে বাস করে। এরমধ্যে প্রতিনিয়তই ভয়াবহ যানজটের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। রাজধানীবাসীর জন্য যানজট খুব চেনা দৃশ্য হলেও, রমজান মাস এলেই এ চিত্র আরো ভয়াবহ হয়। প্রতিবছরের মতো এবারও তেমনটাই লক্ষ করা যাচ্ছে। অথচ সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উদাসীন।
ঈদ ও রোজাকে কেন্দ্র করে একশ্রেণির দরিদ্র মানুষ রাজধানীতে আসে উপার্জনের আশায়। তাদের একটা অংশ হঠাৎ করেই রিকশা চালায়। এসব নতুন আগন্তুকের নেই শহরের পথঘাট চেনা। জানা নেই সড়কে গাড়ি চালনার ন্যূনতম বিধি। এরা রোজার মাসে যানজটকে বাড়িয়ে দেয় আরেক ধাপ। এবার রোজা শুরুর আগেই রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে তীব্র যানজট দেখা দেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ট্রাফিক বিভাগ চেষ্টা করলেও অনেক ক্ষেত্রে সফলতা আসেনি। তাই এবারও রোজায় যানজট থেকে নিস্তার পাওয়ার ভরসা করতে পারছে না নগরবাসী।
ঢাকা মহানগরীর যানজট নিরসনে বিভিন্ন পরিকল্পনা-প্রকল্প চলছেই। এই নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থা নিয়ে বছরের পর বছর ধরে অনুষ্ঠিত বৈঠকও সুফল বয়ে আনতে পারেনি। ঢাকা শহরে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষের বসবাস। এর প্রায় ৭৬ শতাংশই নানা প্রয়োজনে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করে। এতে সময় ব্যয় হয় দৈনিক গড়ে ২ ঘণ্টা ৩৫ মিনিট। এর মধ্যে যানজটে আটকে থেকে দৈনিক মাথাপিছু সময় নষ্ট হচ্ছে দেড় ঘণ্টা। এতে বছরে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। ফলে রাজধানীর ৭৩ শতাংশ মানুষ শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে। রমজান মাসে রাজধানীর ফুটপাতে দোকানের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতা ও যানবাহনের সংখ্যাও বেড়ে যায়। যানজট নিরসনে ট্রাফিকপুলিশ সদস্যদের যে অতিরিক্ত কষ্টকে মেনে নিতে হয় এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কিন্তু উল্টো দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্যের যোগসাজশেই অবৈধ সড়ক-ফুটপাত দখল করে যে বাণিজ্য চলে, তা কর্তব্যরত পুলিশ ও জনভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
জনদুর্ভোগ নিরসনের দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। ঢাকাকে তিলোত্তমা নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে হলে নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। যানজটমুক্ত করতে জনসচেতনতাও জরুরি। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে সমন্বিত উদ্যোগ নিলে যানজট দূর করা অনেকটা সম্ভব হবে। ঢাকার যানবাহনের গতিশীলতা ক্রমেই নাজুক হচ্ছে। ‘নগর পরিস্থিতি ২০১৬ : ঢাকা মহানগরে যানজট, শাসনব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিত’ শীর্ষক এক সেমিনারে প্রকাশিত গবেষণা রিপোর্টে দেখা যায়, ২০০৪ সালে যেখানে ঢাকার গণপরিবহনের ঘণ্টায় গড় গতি ছিল ২১.২ কিলোমিটার সেখানে ২০১৫ সালে এসে তা ৬.৮ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। যানজট ও ধীরগতির কারণে সাধারণ কর্মজীবী মানুষের আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও রিপোর্টে তুলে ধরা হয়েছে। যানজট ও যানবাহনের ধীরগতির কারণে বছরে ক্ষতি ১১.৪ বিলিয়ন ডলার বা লক্ষ কোটি টাকা। শুধু ধীরগতির কারণেই বছরে ক্ষতি হচ্ছে তিন হাজার কোটি টাকা। গবেষণা রিপোর্ট অনুসারে, যানজটের কারণে ঢাকায় প্রতিদিন ৮.১৬ মিলিয়ন কর্মঘণ্টা সময় নষ্ট হচ্ছে। শুধু উৎপাদনশীলতা বা আর্থিক মানদণ্ডে এই ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ সম্ভব নয়। দেশ ও নগরবাসীর ওপর ঢাকার যানজটের অর্থনৈতিক, সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক ক্ষয়ক্ষতি আরো ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। যানজটে কর্মঘণ্টা অপচয়, জ্বালানি অপচয়, পরিবেশগত দূষণ, শব্দদূষণ, বাণিজ্যিক যোগাযোগ ও পরিবহনে স্থবিরতার ক্ষতির পাশাপাশি স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থী, ইমার্জেন্সি রোগী পরিবহনে বিড়ম্বনা ইত্যাদি বিষয় যেকোনো বাসযোগ্য নগরীর অন্যতম বিবেচ্য বিষয়।
দেশের অবকাঠামো দুর্বলতা, শাসনব্যবস্থায় দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কারণে অনেক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না। প্রতিবছর দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ অবৈধ পথে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। দেশে বিনিয়োগে অনাস্থা, অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার পেছনের কারণগুলোর সঙ্গে সুশাসন ও জননিরাপত্তায় আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর ব্যর্থতার পাশাপাশি বন্দর, সড়ক-মহাসড়ক ও নগরীতে যানজট পরিস্থিতি অন্যতম অনুঘটক। গণপরিবহনে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য ও ফুটপাতের দখলদারিত্ব টিকিয়ে রাখার পেছনে সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহলের দুর্নীতিবাজরা সর্বদাই ধরাছোঁয়ার বাইরে। এসব খাতে বছরে ১৮২৫ কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়ে থাকে বলে বিআইজিডির রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। ঢাকার নাগরিক সমস্যা নিরসনে নগর সরকারের প্রয়োজনীয়তার কথা দীর্ঘদিন ধরে বলা হলেও সে বিষয়ে কোনো উদ্যোগ সরকারের পক্ষ থেকে কখনো দেখা যায়নি। ঢাকা শহরের যানজটসহ বহুবিধ এবং নাগরিক সমস্যা হয়তো রাতারাতি সমাধান করা সম্ভব নয়। তবে নগরীর ৩০টি সেবা সংস্থার কাজে সমন্বয় করা সম্ভব হলে অর্ধেক কমে আসতে পারে। ইতোমধ্যে নগরীর দুই সিটি করপোরেশনের মেয়রদ্বয় সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়ের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন বলে জানা যায়। সেই সঙ্গে নগরীর শিল্প-কারখানা ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের বিকেন্দ্রীকরণের বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নিতে হবে। যানজটমুক্ত, নিরাপদ, গতিশীল ও পরিবেশবান্ধব নগরী গড়ে তুলতে হলে আধুনিক ও দীর্ঘমেয়াদি নগর পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করতে হবে। সর্বোপরি দখলবাজি, চাঁদাবাজিমুক্ত স্বচ্ছ ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
ছুটির দিনগুলোতেও যানজটের নিয়তি এড়ানো নগরবাসীর জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। মহাসড়কগুলোতে প্রায়ই লেগে থাকে মহাযানজট। দেশের অগ্রগতি থামিয়ে দিচ্ছে এ ভয়ঙ্কর সমস্যা। সময়ের এক ফোঁড় আর অসময়ের দশ ফোঁড় সমান কথা। সময় ও নদীর স্রোত কারো জন্য বসে থাকে না। যানজটের কারণে যে সময় নষ্ট হচ্ছে অর্থনীতির বিচারে তা ভয়াবহ। এ সমস্যা উৎপাদনশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। দেশের রফতানি-বাণিজ্যকে অনিশ্চিত করে তুলছে। বিদেশিরা বাংলাদেশের রাজধানীকে অস্বস্তির দৃষ্টিতে দেখেন যানজটের কারণে। যেসব কারণে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হচ্ছে যানজট তার অন্যতম। এ সমস্যা সমাধানে পূর্বসূরিদের মতো বর্তমান সরকারের উদ্যোগ থাকলেও তার অবস্থা কাজির গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নেই-এর মতো। সরকার রাজধানীর যানজট সমস্যা সমাধানে ফ্লাইওভার চালুসহ নানা প্রকল্প গ্রহণ করলেও প্রতিটি প্রকল্পেই রয়েছে সমন্বয়হীনতা। একই সঙ্গে বলা যায়, রাজধানীর যানজট নিরসনে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও মেট্রোরেল নির্মাণই যথেষ্ট নয়, ট্রাফিক ক্ষেত্রে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনাও নিশ্চিত করতে হবে। রাজধানীর ফুটপাত ও রাজপথ অবৈধ দখলমুক্ত না হলে যানজটের থাবা ঠেকানো দুরূহ হয়ে পড়বে। যানজট নিরসনে যেখানে সেখানে পার্কিং বন্ধ ও চলাচল ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হতে হবে। রাজধানীর ফুটপাত অবৈধ দখলমুক্ত এবং যেখানে সেখানে পার্কিংয়ের প্রবণতা রোধ করা গেলে যানজট অন্ততপক্ষে ৯০ ভাগ নিরসন করা সম্ভব হবে। বিষয়টি সবার জানা থাকলেও ফুটপাত অপদখলের সঙ্গে রাজনৈতিক টাউট, মাস্তান ও প্রশাসনের উৎকোচভোগীদের স্বার্থ থাকায় তাদের নিরস্ত করতে কেউ এগিয়ে আসছে না।
উৎপাদনের জন্য যে সময় ব্যয় হওয়ার কথা তা গিলে খাচ্ছে এ সমস্যা। গত এক দশকে যানজটে অপচয় হওয়া সময় ব্যবহৃত হলে বাংলাদেশ অনেক আগেই মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হতো। ফলে এ সমস্যা সমাধানে সরকারের আন্তরিক প্রয়াসই এখন লক্ষ্য হওয়া উচিত।
দৈনিক দেশজনতা/ এমএইচ