নিজস্ব প্রতিবেদক:
রমজান মাস সাম্যের শিক্ষা দেয়। ধনীকে উপলব্ধি করায় গরিবের দুঃখ। আর এ শিক্ষার চাক্ষুস প্রমাণ মেলে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের প্রাঙ্গনে। সেখানে হাজার হাজার মানুষ একসাথে সমবেত হয় ইফতার করতে। কোনো ভেদাভেদ নেই, নেই কোনো উঁচু নিচু। সবাই সমান হয়ে যায় ইফতারের মজলিসে। মাটিতে বসে একই রকম ইফতার খায় মিলে মিশে। রমজানের তিরিশটা দিন এদৃশ্য দেখা যায় বায়তুল মোকাররমে।
ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন নোয়াখালী থেকে এবারের রোজায় এসেছেন রাজধানী ঢাকাতে। উঠেছেন এক আত্মীয়ের বাড়িতে। তবে এক সন্ধ্যায় সে বাড়িতে ইফতার না করে মাগরিবের আগে ভাগে দুই সন্তানকে নিয়ে সোজা চলে এসেছেন বায়তুল মোকারমে। উদ্দেশ্য রমজানে বায়তুল মোকারমের চত্ত্বরে বসে নানান শ্রেণি পেশার মুসল্লিদের সাথে একসাথে বসে ইফতার করবেন। দুই সন্তানকে শেখাবেন ইসলামের সাম্যের বার্তা। তারা যাতে বোঝে কিভাবে ইসলামের সাম্যের শিক্ষাকে বুকে নিয়ে সব শ্রেণি পেশার মানুষ একসাথে একই জায়গায়, একই রকম প্লেটে, একই খাবার খেয়ে, একসাথে ইফতার সেরে একই কাতারে নামাজ পড়ে।
আনোয়ার হোসেন কিংবা তার সন্তান নন, তাদের মতন প্রায় তিন হাজার রোজাদার প্রতিদিন একই সাথে বসে ইফতার করেন বায়তুল মোকারমে। দুই শতাধিক নারীও শরিক হন এই ইফতারে।
২০০৯ সাল থেকে বড় পরিসরে ইফতারের আয়োজন করার এই উদ্যোগ নেন জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকারম কর্তৃপক্ষ। প্রথম দিকে এক হাজারের মতো রোজাদার ইফতারে অংশ নিলেও আস্তে আস্তে লোক সমাগম বাড়তে থাকে। ইফতারের খাবার তৈরিতে গত বছর ১৫ লক্ষ টাকা বাজেট থাকলেও এবার সে বাজেট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ লক্ষ টাকা। প্রতিদিন ৯০ হাজার টাকা খরচ হয় ইফতারে।
নানান পদ সরবরাহ করানো হয় বিভিন্ন ঠিকাদারদের মাধ্যমে। রমজানের আগেই টেন্ডারের মাধ্যমে খাবার সরবরাহের অনুমতি পান ঠিকাদাররা। যিনি সব থেকে কম দাম চান তিনিই মূলত কাজ পান খাবার সরবরাহের।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মসজিদ ও মার্কেট বিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ মহীউদ্দিন মজুমদারের সাথে কথা হয় এ উদ্যোগ নিয়ে। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রায় তিনশ বড় ডিশে ইফতার সাজানো হয় প্রতিদিন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ আসেন ইফতার করতে। কারণ অনেকের শখ থাকে বায়তুল মোকারমে একবার ইফতার করার। আমরা সকল সময় তদারকির মাধ্যমে চেষ্টা করি কোন মুসল্লি যাতে ইফতার ছাড়া ফিরে না যায়। এবারে ইফতারের প্রথম প্রথম দিন দুই হাজারের মতো মুসল্লি অংশ গ্রহণ করেছিলো। পরে সেটা বেড়ে দাড়িয়েছে প্রায় তিন হাজারে।’
মুহাম্মদ মহীউদ্দিন মজুমদার জানান, প্রতিদিনের ইফতারে শরবতের জন্য ১৫টা রুহ আফজা ও ৪০ কেজি চিনি লাগে। এছাড়া খেজুর ৬০ কেজি, ছোলা ১১০ কেজি, পেঁয়াজু ৯০ কেজি, বেগুনি ৮০ কেজি, মুড়ি ৭০ কেজি, জিলাপি ৯০ কেজি প্রতিদিন লাগে। তবে কলা অর্ধেকটা আর শশা পরিমাণ মতো দেওয়া হয়। প্রতিদিনের ইফতারে মাথা পিছু খরচ হয় ৪৫ টাকা।
ইফতার করার নিয়ত নিয়ে আসরের নামাজের পর থেকেই শুরু হয় জমায়েত। এসময় ইসলামিক ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে শুরু হয় ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা। শত শত মানুষ বসে বসে সে আলোচনা শোনেন। কেউ কেউ জড়ো হন হাদিস জানতে, আগ্রহের সাথে হাদিসের বই পড়তে থাকেন তারা।
ইফতারের আগে নয় পদের ইফতার সাজানো হয় বড় বড় পাত্রে। এরই মধ্যে মুসল্লিরা ধনী-গরিব ভেদাভেদ ভুলে জড়ো হতে থাকেন ইফতারের পাত্রগুলোর চারপাশে। ছয় থেকে আটজন পর্যন্ত বসেন এক একটা পাত্রের চারধারে।
ইফতারের সময় যত এগিয়ে আসে ততই ব্যস্ততা বেড়ে যায় খাদেমদের। শরবত তৈরি, দস্তরখান পাড়াসহ বিভিন্ন কাজ শুরু করেন তারা। মসজিদের খাদেম নুরু মিয়া জানান, দীর্ঘ সাত ছয় বছর ধরে তিনি এখানে ইফতারের সময় ইফতার সাজানোর কাজে জড়িয়ে আছেন। কত লক্ষ লক্ষ মানুষ দেখেছেন এখানে। অথচ কাউকে কোন সময় কারো সাথে ভেদাভেদ করতে দেখেননি।
সাভার থেকে আসা তানভীর হোসেন নামে এক তরুণের সাথে কথা হলো। জানালেন, সাম্প্রতিক সময়ে এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে তার। বায়তুল মোকারমে ইফতার করবার অনেক দিনের শখ ছিল। তাই দুই বন্ধুর সাথে ইফতার করতে এসছেন। ইফতার সেরেই আবার বাড়ির বাস ধরবেন।
কথা হয় ভ্যানচালক হাসান আলীর সঙ্গে। তিনি জানান, মতিঝিল এলাকায় প্রতিনিয়ত ভাড়া শেষ করে প্রতিদিন বায়তুল মোকারমে ইফতার করেন। তার সাথে বিভিন্ন সময় সমাজের উচ্চ শ্রেণির মানুষ ইফতার করে। কিন্তু কখনো তাকে নিচু ভাবেন না তারা। কারণ আল্লাহকে রাজি খুশি করতে রোজা থাকে সবাই, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই ইফতার। সেখানে ধনী-গরিব এর কিছু নেই।
দৈনিক দেশজনতা/ এমএইচ