পথচারিদের জন্য নির্বিঘ্নে সড়ক পারাপারে প্রথম বারের মতো রাজধানীর আসাদ অ্যাভিনিউয়ের গ্রিন হেরাল্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের সামনে ডিজিটাল পুশ বাটন সিগন্যাল বসিয়েছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)।
সড়ক পারাপার হতে চাইলে সিগন্যালের একটি বাটনে পুশ করলেই নির্ধারিত সময় পরে সড়কের দুপাশে গাড়ি দাঁড়ানোর জন্য সংক্রিয়ভাবে লাল বাতি জ্বলে উঠবে। এরপর পথচারিরা রাস্তা পারাপারের জন্য সময় পাবেন ২৫ সেকেন্ড। এ সময় সড়কে চলবে না কোনো গাড়ি। এতে পথচারি পারাপারে দুর্ঘটনা কমার আশা করছিলেন পুশ বাটন সিগন্যালের নির্মাতারা।
তবে, দ্রুত গাড়ি চালানোর প্রবণতা ও পথচারীদের দ্রুত রাস্তা পারাপারের মানসিকতার কারণে ডিজিটাল পুশ বাটন সিগন্যাল কোনো কাজে আসছে না বললেই চলে। এক্ষেত্রে সিগন্যালে দায়িত্বরতরা বলছেন, ‘আইন না মানার প্রবণতার কারণে এতো ভালো উদ্যোগ ভেস্তে যাচ্ছে। ’
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, পুশ বাটন সিগন্যাল মূলত পথচারিদের নির্বিঘ্নে রাস্তা পারাপারের জন্য তৈরি করা হয়েছে। এটি নিয়ন্ত্রণ করবে পথচারিরাই। ফলে গাড়ি থামার জন্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না। রাস্তা পার হতে প্রথমে পুশ বাটনে চাপ দিতে হবে। এর পর ১২৭ থেকে কাউন্টডাউন শুরু হবে। এরপর রাস্তা পারাপারের জন্য ২৫ সেকেন্ড সময় পাবেন পথচারিরা। এ সময়ে পথচারিররা রাস্তা পার হবেন এবং দুই পাশে গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকবে।
সরেজমিনে গ্রিন হেরাল্ড স্কুলের সামনে অবস্থান নিয়ে দেখা গেছে, রাস্তা পারাপারে কেউই পুশ বাটন ব্যবহার করছেন না। যে যার মতো করে গাড়িকে হাতের মাধ্যমে সিগন্যাল দিয়ে থামিয়ে রাস্তা পার হচ্ছেন। কেউবা আবার দৌড়ে দৌড়ে রাস্তা পার হচ্ছেন।
অনেককে জেনে বা কৌতুহলবশত পুশ বাটনে চাপ দিতে দেখা গেছে। তবে পথচারি পারাপারের জন্য সময় শুরু হলেও যানবাহন চলাচল করতে দেখা গেছে। কোনো চালকই সিগন্যাল মানেননি।
যদিও, উত্তর সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সিগন্যালে ক্যামেরা বসানো হবে, কোনো গাড়ি সিগন্যাল না মানলে তার বিরুদ্ধে অটোমেটিক মামলা হয়ে যাবে। তবে এ কার্যক্রমের এখনো বাস্তবায়ন হয়নি বলে সিগন্যালে দায়িত্বরতরা জানিয়েছেন।
যাদের জন্য সিগন্যাল তারাই মানেন না
আসাদ অ্যাভিনিউ এলাকায় ডিজিটাল পুশ বাটন সিগন্যাল বসানোর পর ওই এলাকার পথচারিদের পাশাপাশি সবচেয়ে সুবিধাভোগী হিসেবে ধরা হয়েছিল গ্রিন হেরাল্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের। এজন্য এটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও দেয়া হয় প্রতিষ্ঠানটিকে। তবে দেখা গেছে, ওই স্কুলের শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা এটি ব্যবহার করেন না।
স্কুল ছুটির সময় অভিভাবকরা যখন রাস্তা পার হয়ে গেটের সামনে আসেন তখন সিগন্যাল মানেন না। এমনকি ছুটির পর শিক্ষার্থীদের বাসায় নিয়ে যাওয়ার সময়ও তারা সিগন্যালের অপেক্ষা করেন না।
এতে শিক্ষার্থীদের জন্য এই উদ্যোগটি নেওয়ার পরও তারা সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে রয়েছেন বলে মনে করছেন অনেকে।
সিগন্যালের পাশে অপেক্ষমান অভিভাবক নিগার সুলতানা বলেন, ‘সিগন্যালের বিষয়টি খেয়াল থাকে না। যেহেতু এতো ভালো উদ্যোগ সেহেতু আমাদের ভালভাবে ব্যবহার করা উচিত।’
আরেক অভিভাবক সুমনা ইসলাম বলেন, ‘সিগন্যাল ব্যবহার না করা অবশ্যই ঝুঁকি। তবে এখানে যে সিগন্যাল বসানো হয়েছে তা অনেকেই জানেন না। আবার সিগন্যাল দিলে গাড়িও দাঁড়ায় না। ’
প্রচারণার অভাব
গ্রিন হেরাল্ড ইন্টার ন্যাশনাল স্কুলের সামনে পুশ বাটন সিগন্যাল বসানো হলেও এর কোনো প্রচারণা নেই বলে অভিযোগ পথচারিদের। এমনকি এর ব্যবহার বিধি সম্পর্কেও সাধারণ মানুষদের কোনো ধারণা দেয়া হয়নি।
সিগন্যাল মেনে আসা ব্যাংক কর্মকর্তা আবদুর রহমান বলেন, ‘অনেকে জানেই না এখানে পথচারিদের জন্য সিগন্যাল আছে। আবার যারা এটি দেখে বুঝতে পারছেন তারাও এর ব্যবহার জানেন না।’
আরেক পথচারি বলেন, ‘পথচারিদের জন্য এখানে যে সময়টা দেওয়া হয় তা যথেষ্ট। কিন্তু কেউ এটা মানেন না। প্রথমত প্রচারণা নাই। দ্বিতীয়ত আমাদের আগের অভ্যাসটা এখনো রয়ে গেছে।’
চালক-পথচারিদের ধৈর্য কম
সিগন্যাল মেনে পথচারিদের নির্বিঘ্নে চলাচলে সহযোগীতা দুই শিফটে চার জন নিরাপত্তা গার্ড দায়িত্ব পালন করেন। সকাল ৬টা থেকে ২টা এবং ২টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত এ চারজন দায়িত্ব পালন করেন।
দেখা গেছে, যখন পারাপারের জন্য পথচারির সংখ্যা বেড়ে যায় তখন তারা পুশ বাটন অন করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে গাড়ি থামান এবং নিরাপদে তাদের পারাপারে সহযোগীতা করেন।
এক্ষেত্রেও দেখা গেছে, হাতের ইশারায় গাড়ি থামানোর জন্য বলা হলেও বাস, হিউম্যান হলার, সিএনজি, মোটরসাইকেলসহ সব ধরনের যানবাহন দাঁড়াতে চায় না।
নাতিকে স্কুল থেকে নিতে আসা অবসরপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ওয়াজেদুল্লাহ বলেন, ‘আইন না মানলে তো হবে না। আমার মনে হয় মানুষের একটু সজ্ঞান হওয়া উচিত।’
পুশ বাটনে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা মাহবুবুল বলেন, ‘চালক-পথচারিদের ধৈর্য খুব কম। সবাই দ্রুত যেতে চায়। কিন্তু জীবনের জন্য কোনো পরোয়া করে না।’
দায়িত্বরত আরেক নিরাপত্তা গার্ড বলেন, ‘স্কুলে আসার সময় বা ছুটি হলে অভিভাবকরা পাগলের মতো হয়ে যান। কখন তাদের সন্তানদের নিয়ে বাসায় যাবেন সে জন্য এক ধরনের প্রতিযোগীতায় মেতে ওঠেন। কেউই সিগন্যাল ব্যবহার করতে চান না। ’
সিগন্যাল জানেন না চালকরা, আটকাতে রেল ক্রসিং পদ্ধতি
পথচারিদের জন্য সিগন্যাল পড়ার পর গাড়ি না থামায় সিগন্যালের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, সচেতন করা হলে পথচারি সিগন্যাল মানবেন। তবে গাড়ির চালকরা দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে তাড়াহুড়ো করে। এ জন্য সিগন্যালের সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। এজন্য রেল ক্রসিয়ের মতো পদ্ধতি করা দরকার।
শাওন নামে এক পথচারি বলেন, ‘গাড়ি আটকানোর জন্য রেল ক্রসিংয়ের মতো আটকানো উচিত। তাহলে পথচারি চলাচলের সময় গাড়ি থামবে। ’
এদিকে, কয়েকজন চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা এখানে সিগন্যালের কথা জানেন না।
প্রজাপতি পরিবহনের চালক রাশেদুল বলেন, ‘এখানে ডিজিটাল সিগন্যাল চালু হয়েছে সেটা জানতাম না।’
উল্লেখ্য, গত ২৪ অক্টোবর পথচারিদের নির্বেঘ্নে পারাপারের জন্য ডিজিটাল পুশ বাটন সিগন্যালের উদ্বোধন করে ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম।