অতীত গৌরবের স্বাক্ষী হয়ে এখনো টিকে থাকে ময়মনসিংহের শশী লজ। ব্রহ্মপুত্র তীরের এই নয়নাভিরাম বাড়িটি নির্মিত হয়েছিল জমিদার সূর্যকান্ত আচার্য’র শাসনামলে।
তৎকালীন বিশ্বখ্যাত স্থাপত্য শৈলীর এই শশী লজকে ঘিরে ছড়িয়ে আছে নানা কাহিনী। বাংলা সাহিত্যের বরপুত্র প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদের কালজয়ী টিভি নাটক ‘অয়োময়; এর চিত্রায়ণ হয়েছিল এই শশী লজেই।
শশী লজ সম্পর্কে জানতে অতীতে তাকালে ফিরে যেতে হয় মুক্তাগাছার জমিদারদের ইতিহাসে ।
মুক্তাগাছার জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা পুরুষ শ্রীকৃষ্ণ আচার্য’র তৃতীয় উত্তরপুরুষ রঘুনন্দন আচার্য ছিলেন নিঃসন্তান। ফলে তিনি গৌরীকান্ত আচার্যকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করেন। দত্তক পুত্রের হাতে জমিদারির ভার অর্পণ করে কিছুদিনের মধ্যেই তিনি প্রয়াত হন। জমিদার গৌরীকান্ত আচার্যও নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেলে তার বিধবা পত্নী বিমলা দেবী দত্তক নেন কাশীকান্তকে। কাশীকান্ত পরলোকগমন করলে তার বিধবা পত্নী লক্ষ্মী দেবী আচার্য পূর্বসূরিদের পথ অনুসরণ করে পুত্র হিসেবে দত্তক নেন চন্দ্রকান্তকে। তিনিও মারা যান খুবই দ্রুত। তবে হাল ছাড়েননি লক্ষ্মী দেবী। দ্বিতীয় দত্তক নেন পূর্ণচন্দ্রকে। লক্ষ্মী দেবী স্বীয় জমিদার বংশের সাথে মিল রেখে দত্তক পুত্রের নতুন নাম রাখেন সূর্যকান্ত আচার্য।
সূর্যকান্ত’র শাসনামলে ব্রহ্মপুত্র তীরবর্তী জনপদে যুক্ত হয় নবমাত্রা। তার দক্ষতা, বীরত্ব গাঁথার সাথে সাথে বিস্তৃত হয় জমিদারিও। প্রায় ৪১ বছর জমিদারি পরিচালনার প্রশস্ত প্রেক্ষাপটে বহু জনহিতকর কাজ করেন তিনি। ময়মনসিংহে স্থাপন করেন একাধিক নান্দনিক স্থাপনা।
ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকে ময়মনসিংহ শহরের কেন্দ্র স্থলে ৯ একর ভূমির ওপর একটি অসাধারণ দ্বিতল ভবন নির্মাণে হাত দেন সূর্যকান্ত। নাম রাখেন শশী লজ। বিখ্যাত এই ভবনটি ১৮৯৭ সালের ১২ জুন গ্রেট ইন্ডিয়ান ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হলে অত্যন্ত ব্যথিত হন সূর্যকান্ত। ১৯০৫ সালে ঠিক একই স্থানে নতুনভাবে শশী লজ নির্মাণ করেন তারই পুত্র পরবর্তী জমিদার শশীকান্ত আচার্য।
১৯১১ সালে শশী লজের সৌন্দর্য বর্ধনে তিনি অপরূপ শৈলীতে সম্পন্ন করেন আরও কিছু সংস্কার কাজ। নবীন জমিদারের এই প্রয়াসে শশী লজ হয়ে ওঠে অনিন্দ্য সুন্দর, অপরূপ।
দেশভাগের পরে বিলুপ্ত হয়েছে জমিদারি প্রথা। স্বপরিবারে জমিদাররা চলে যান ভারতে। কিন্তু রেখে গেছেন তাদের সেই কর্ম। কালের করাল গ্রাসে শশী লজ খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও ঐতিহাসিক স্থাপনা সংরক্ষণে রাষ্ট্রপক্ষের দায়িত্বশীলদের উদাসীনতার কারণে নষ্ট হয়েছে ভবনটির ভৌত অবকাঠামো। ১৯৫২ সালে শশী লজে স্থাপিত হয় মহিলা টিসার্স ট্রেনিং কলেজ। নানা কারণে শত ক্ষত নিয়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছে ভবনটি।
মূল শহরে দৃষ্টি ফেললে উদ্ভাসিত হয় উঁচু দেয়াল ঘেরা শশী লজের প্রবেশদ্বার। ভেতরে প্রবেশ করলেই শান বাঁধানো প্রবেশ পথের সামনেই শশী লজের সাজানো বাগান। বিচিত্র প্রজাতির ফুলশোভিত সেই বাগানের মধ্যভাগে বৃত্তাকার জল ফোয়ারা। ফোয়ারা কেন্দ্রে অনুচ্চ বেদির ওপর দন্ডায়মান গ্রিক স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত স্বল্পবসনা নারী মূর্তি। বাগানের ঠিক পেছনেই লালচে ইট আর হলুদ দেয়ালে নির্মিত শশী লজ।
বারান্দা অতিক্রম করে কয়েক ধাপ সিঁড়ি পেরোলেই রঙ্গালয়। সুদৃশ্য সেই রঙ্গালয়ের এক প্রান্তে বিশ্রাম ঘর। বিশ্রাম ঘরের পর কাঠের মেঝেযুক্ত হলঘর। হলঘরের পাশেই বর্ণিল মার্বেল পাথরে নির্মিত আরেকটি জলফোয়ারা। জলফোয়ারার ঠিক ওপরের ছাদ থেকে নিচে ঝোলানো স্ফটিক স্বচ্ছ কাঁচের ঝাড়বাতি।
রয়েছে বহু কক্ষ, পরিচর্যাহীন, ধুলোমলিন সেই কক্ষগুলোর কোনোটি তালাবদ্ধ, কোনোটি নানা রকম অশোভনীয় আসবাবে ঠাসা। ভবনটির পেছনে একচিলতে উঠোন। সবুজ ঘাসের আঁচল পাতা সেই উঠোন পেরোলে একটি অপরিসর জলাশয়। জলাশয়ের পূর্ব ও পশ্চিম পারে দুটি ঘাট। দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত দ্বিতল স্নান ঘাটটির মনকাড়া সৌন্দর্য যে কাউকে বিমোহিত করে।
ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য এমন স্থান অবশ্যই আকর্ষনের। নতুনভাবে সংস্কার করে শশী লজকে আরো আকর্ষণীয় করে তোলার দাবী এলাকাবাসীর।
সময়ের প্রয়োজনে মূল স্থাপনার সাথে সাংঘর্ষিক নানা স্থাপনা নির্মাণের ফলে শশী লজ ক্রমেই তার পুরনো রূপ হারাচ্ছে। সম্প্রতি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ভবনটিকে পুরাতত্ত্ব হিসেবে চিহ্নিত করে অধিদপ্তরে সংযোজন করেছে। আদল ঠিক রেখে এটিকে পর্যটক আকর্ষনীয় করে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।